নব্যদীপ্তি_শুদ্ধ চিন্তায় তারুণ্য

“ধর্ষণমুক্ত বাংলাদেশ।”

“সেই চাঁদের আলো!
যেন নিবিয়ে আসছে
চারিদিক বাঁধা অদেখা কালো
এক নিস্তব্ধ অন্ধকারাবৃতা নিশীথের মাঝে
আজিকের এ নিঝুম রজনী –
নিশ্চুপ প্রকৃতি অচেনা সাজে!
কী আশ্চর্য!
আজকেও কিন্তু পূর্ণিমা আকাশে মেঘ ছিল না
ছিলনা কোনো হরতাল
রাজপথ নাকি আজ দিনভর উত্তাল!
কি একটা ভয়ানক রাত!
দু:স্বপ্নগুলো আজ বাস্তবতার নামান্তর
ক্লান্ত পদচারণ – অনেকটা গুলিবিদ্ধ হরিণীর মতো
চোখের সামনে ঝাপসা পৃথিবী নিরুত্তর।
একটা মানুষ,
একটা মানুষও যে এগিয়ে আসছে না
সকালসকাল কত্তো মানুষ ছিল এই রাজপথে
কোথায় হারিয়ে গেল তারা?”

খুব বেশি দিন আগের কথা না, কোনো একটা কেইস হঠাৎ করেই যেন ঘুম থেকে তুলেছিল কিছু মানুষকে। আর আমাদের দেশে একজনের জাগ্রত হওয়ার গল্পটা অনেকটা কুম্ভকর্ণের নিদ্রা সমাপ্তির ন্যায়। আর সেই ঢাকঢোলে সাড়া দিয়ে একটা আচমকা উদ্বোধন ঘটে কারো মাঝে। কেউ কেউ তো প্রেক্ষাপটের দ্বারা এতোটাই প্রভাবিত হন, যে তার জাগ্রত হওয়াটা একটা ঘুমন্ত স্বপ্নপথিকের মতো। আবার! কারো কাছে তা সাময়িক হ্যালুসিনেশন, কারো কাছে ক্ষণিকের স্লিপ প্যারালাইসিস। না, আমি বলছিনা যে সবাই আমরা বিভ্রান্তিতে পড়ে হুজুগ মাতিয়ে পথে নেমে পড়ি। কেউ কেউ আছে ,ঢাকের শব্দটা পৌঁছায় যাদের একদম মণিকোঠায়। এরাই প্রকৃত সংগ্রামী। হ্যাঁ, বলছি ধর্ষকের ফাঁসির দাবিতে দেশজুড়ে বিক্ষোভরত হাজারো ছেলেমেয়ের কথা। উদ্দেশ্যটা যে ছিল সামগ্রিক কল্যাণ, এতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু পার্থক্যটা গড়ে দেয়, ঐ যে কিছু স্লিপ প্যারালাইজড বিভ্রান্ত কাহিনী।

।।হায়নাগুলো নাকি ফাঁসিতে ভয় পায় না!
ধরে ফেলেছে তাদের ছোট্ট মনের অসুর
“আমি যে এসেছি তোমাদেরই কাছে ফিরে
আমায়, আমায় তোমরা চিনতে পারছো না!”
একবারও তাকচ্ছে না, লজ্জা ক্ষোভের জয় জয়াকার
তপ্ত বিকেলের ছলোছলো বৃষ্টি
যেন ঘনিয়ে এনেছে এ রাতের কালো মেঘ
আমার সোনার বাংলায় একি অনাসৃষ্টি!
ধিক্কার, তোদের সহস্র ধিক্কার
এই বাংলার মাটিতে যারা এনেছিস ধুসর ছায়া
এই যে ধুসরতা – একদিন উঠে যাবেই!
সতের কোটি কণ্ঠ সেদিন জুড়াবে
সম্মিলিত জয়োধ্বনিতে!
জয় বাংলার আগুনে ভস্মীভূত হবে তোদের কালো নিশান
আমার এই বাংলার মাটিতে তোদের কোনো জায়গা নেই।।

শুধু ধর্ষকের বিরুদ্ধে আন্দোলন করে হয়তো সাময়িক পরিবর্তন এসেছে, কিন্তু স্থায়ী সমাধান আনতে স্বমূলে আঘাত হানতে হবে , যেমন তেমন আঘাত না, সতের কোটি মানুষকে এক হতে হবে আজ। আমাদের নৈতিকতার অবক্ষয় ঠেকাতে হবে শুরু থেকে। কেন জানিনা মনে হয় আমাদের জন্য কোনো সমস্যার স্থায়ী সমাধান একাদশে বৃহস্পতি! এইতো সেদিন কতো ছাত্র রাস্তায় নেমেছিল নিরাপদ সড়কের দাবিতে, কিন্তু তৃতীয় পক্ষের কারসাজিতে এই পবিত্র সংগ্রামও কলুষিত হয়নি কি?
আমরা আইনের পাতার ফাঁসি দেখে অভ্যস্থ, তার বাস্তবতা একান্ত কাম্য।

।।আমি আজ নিস্তব্দ রজনীর অবসান
আমি ঘন মেঘের বিজলীবাতির জয়গান
আমার বোনের রক্তমাখা দেহ আমার অস্ত্র
আমার মায়ের অসহ্য কান্নায় আমি লজ্জায় বিবস্ত্র
আমি আজ ঘরে ঘরে
জাগো হে স্বপ্নদেখা আগামীর পথিক
জাগো স্বাধীন দেশের স্বাধীন নাগরিক
জ্বলে ওঠো তিমির রাত্রী
আমাদেরই গানে সুর লাগাও হে দুরন্ত যাত্রী
আমাদের যাত্রা আজ দুস্তর
আমাদের পথ অনন্তর।।

আসা যাক বাস্তবতায়। আমার বিশ্বাস, সমস্যার সমাধান আসে, সমস্যা সম্পর্কে সুষ্ঠু জ্ঞানের উপর নির্ভর করেই। ধর্ষণের কারণ কী? আচ্ছা, আমরা কারণ সম্পর্কে সবাই খুব বেশিই জানি, বিশেষ করে এই কয়েকদিনে ধর্ষণের ধারণাহীন বাচ্চাটাও জেনে গিয়েছে কেন হয় ধর্ষণ। তাই সমাধানে যাচ্ছি সরাসরি। সমাধানটা মোটেই এক দিন বা দুই দিনে আসবে না। সাময়িক স্থিতিশীলতার জন্য কঠোর আইনের সুষ্ঠু প্রয়োগ আর গণসচেতনতামূলক কার্যক্রম কিছুটা সহায়ক হতে পারে। যাই হোক কথায় আসি।
বাংলার মানুষ চিরায়ত হৃদ্যতায় বিশ্বাসী। মানে না কোনো ধর্ম, বর্ণ কিংবা জেন্ডারের ভেদ। ঐকান্তিক মনোভাব আমাদের রক্তে। কিন্তু এই রক্ত কলুষিত হবে কেন যদি না তাতে কোনো বর্জ্য মেশানো হয়? সেই বর্জ্য আবার কিছুটা বিচিত্র। বিষয়টা এমন যে, পুষ্টির জন্য দুধ খেতে গিয়ে আমরা আবার দুধের সাগরে পড়ছি নাতো? সাঁতার জানাটা কিন্তু একান্ত জরুরি। গ্লোবালাইজেশন এর এ যুগ মানুষের চিরায়ত পরিচয়কে বদলে দিয়েছে। মানুষ এখন বিশ্বনাগরিক। স্বাভাবিকভাবেই সংস্কৃতির আদানপ্রদান ঘটে যায়, যা আমাদের জন্য একান্ত প্রয়োজন। কিন্তু সেইসাথে আসে কিছুটা অপসংস্কৃতির অস্বচ্ছ তরল সাগর। কেউ তাতে ডোবে, আবার কেউ সাঁতরিয়ে পেরিয়ে যায়। পার্থক্যটা গড়ে দেয় সামান্য কিছু শিক্ষা আর মানসিকতা।

আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন প্রধান ভূমিকা রাখতে পারে একজন সফল সাঁতারু হিসেবে গড়ে তুলতে। ধর্ম ও নৈতিক শিক্ষা নামক বিষয় হয়তো আছে দেশের সিলেবাসে, কিন্তু তার বাস্তবায়ন না থাকার কারণ হলো, আমাদের পরীক্ষানির্ভর মনমানসিকতা। আর আমাদের ছোট ছোট ছেলে মেয়েদের উপর এতোটাই বইএর বোঝা চাপিয়ে দেয়া হয়, যা মুখস্থ করে তারা জীবনকে নিষ্পেষিত করে তোলে। তার ফলে শিক্ষার প্রকৃত সৌন্দর্য শিক্ষার্থীদের অগচোরেই থাকে। নাহলে সে সারাদিন নিজের বুকশেল্ফকে নতুন নতুন বই দিয়ে সাজিয়ে তাদের সাথে অপূর্ব সময় কাটাতে পারতো। কেউ আবার কোনো গাণিতিক বা বিজ্ঞানের সমস্যা সমাধানে কাটিয়ে দিতে পারতো ঘণ্টার পর ঘণ্টা। কিংবা নিজের গানের জগৎ কে সুন্দর করতে পারতো আবার নতুন এপ্লিকেশন তৈরি করে সমাধান করতো বাস্তব সমস্যা। এতে সে একটা আনন্দময় জীবনে অভ্যস্ত হয়ে উঠতো। পাশাপাশি গড়ে উঠতো, পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ সহানুভূতি এবং নৈতিক মূল্যবোধ। কেননা, ছোট থেকেই যদি সে নিজের আলাদা সুন্দর জগতে অভ্যস্ত হয়, তার মাঝে গড়ে উঠবে ব্যাক্তিত্ব, সামাজিকতা এবং কমিউনিকেটিভ স্কিল।

পর্ণোগ্রাফিকে বলা যেতে পারে, আজকের ধর্ষণের অন্যতম একটি বড় কারণ৷ সাধারণত প্রযুক্তিতে অনভ্যস্ত যুবকেরা যখন প্রথম ডিভাইস ব্যবহার শুরু করে, তখন তারা ঠিক বোঝে না এর প্রকৃতি। হারিয়ে যায় গভীরতায়। কিন্তু একই কাজটা যদি একদম ছোট বেলা থেকে করানো হতো, তাহলে সে নিশ্চিত বুঝতে পারতো আসল ব্যবহার। আমরা তা করি না, কারণ আমাদের বিশ্বাস ওসব ডিভাইস মানেই খারাপ, সময় নষ্ট। কিন্তু গেইম খেলার মাঝেও যে সৃজনশীলতা আছে- বিষয়টি অভিভাবকদের যেন মনেই হয় না। আমার মতে, প্রযুক্তির সাথে অভ্যস্ততা শুরু হতে হবে আদি থেকেই৷ আর যাই হোক, ৬-৭ বছরের কোনো ছেলে পর্ণ দেখার জন্য ব্রাউজিং করবে না! এটা অনেকটা আমার বলা সাঁতার শেখার একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। হঠাৎ প্রথমবারেই যদি আপনি প্রমত্তা নদীতে সাঁতার কাটতে চান, সমূহ সম্ভাবনা আছে বিপদের। কিন্তু একই কাজ শুরুতে যদি লাইফসাপোর্ট রেখে করেন, নিঃসন্দেহে আপনি একদিন তা ছাড়াই সাঁতার কাটবেন। আর এই লাইফ সাপোর্টটা এখানে শিশুদের অবুঝ মন। যাই হোক, এতে অনেক সময় লাগবে। কী দরকার এতো সময়ের যদি দেশে সমস্ত পর্ণসাইটগুলোকে ব্যান করা হয় কেন্দ্রীয়ভাবে? না তা কিছুটা কঠিন, আবার অনেক অসম্ভব না। আর যাই হোক, বাংলাদেশের আইটি সেক্টরে তো কম মেধা নেই!

আমরা বৈষম্যের অবসান চাই। দেশে কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে আমরা কৃতজ্ঞ। কিন্তু প্রান্তিক পর্যায়ে অপশক্তি আর আধিপত্য নির্মূল আবশ্যক। এতে না থাকবে দূর্নীতি, না কোনো অবিচার। আর আইনের শাসন যখন প্রতিষ্ঠিত হবে, একে কমবে এদের আধিপত্য, একইসাথে বাংলার আবাল বৃদ্ধ বণিতা পাবে সুবিচারের নিশ্চয়তা। তা কী আজ এতোটাই অসম্ভব?
দারিদ্র্যতাকে ধর্ষণের কারণ বললে ভুল হয় কী?
সবশেষে বলতে হয়, শুধু ব্যাক্তিগত কিংবা রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব নয় এটি। দায়িত্ব আজ সবার, পরিবার, প্রতিবেশী, প্রতিষ্ঠান, সমাজ- কেউ দায় এড়াতে পারে? শিক্ষার শুভ সূচনা যখন পরিবারে হবে, আর পারিপার্শ্বিক মাধ্যম হিসেবে থাকবে সুরুচিপূর্ণ মিডিয়া, সংগঠন, বিজ্ঞান ক্লাব, সাহিত্য সংস্কৃতি সংঘ আর নৈতিক মূল্যবোধ সৃষ্টিতে থাকবে এলাকার মসজিদ-মন্দিরের কার্যকর এবং সুদৃঢ় শিক্ষাব্যবস্থা- আর যাই হোক, লাল সবুজের মাটিতে আর ধর্ষণ হতো না।

“ভেংগে ফেলবো মোরা যত বিস্মৃতির এলবাম
লাল সবুজের কাব্যে হারিয়ে দেব যতো আগুনের ফুলকি দূনির্বান
বৈষম্য ছাপিয়ে হাতে হাত রাখো
সমবেত স্বরে বিজয়ের গান গেয়ে যাবো
দূর্ভাগ্য, আমরা ভাষাসৈনিক হতে পারিনি
দূর্ভাগ্য, আমরা বীর মুক্তিযোদ্ধা হতে পারিনি
তবুও কি আমরা সৌভাগ্যবান নই?
স্বাধীন দেশে স্বাধীনতা নিয়ে বেঁচে রই!
আমরা নতুনত্বের যোদ্ধা
আমাদের এ লড়াই, কোনো বিচ্ছেদের নয়
আমাদের সংগ্রাম মিলনের কথা কয়
আমাদের চেতনায় একাত্তর
সাহসে মোরা বাহান্ন, ঐক্যে উনসত্তর
আমরা গড়বো আমাদের দেশ
একটি সুন্দর ভবিষ্যৎ আমরা চাই
থাকবে না বৈষম্য, সমস্বরে মুক্তির গান গাই
আমরাই গড়বো আগামীর পৃথিবী
স্বপ্নের সোনার বাংলা
আমাদের হবেই হবে।।।।”

নব্যদীপ্তিশুদ্ধচিন্তায়_তারুণ্য

এই বিভাগের অন্য খবর

Back to top button