সারিয়াকান্দি উপজেলা

কষ্ট তাদের নিত‌্যদিনের, প্রকৃতির সঙ্গে প্রতিনিয়ত লড়াই

যমুনা নদীর পানি শুকিয়ে যাওয়ায় নতুন সংকটে পড়েছেন বগুড়ার চরাঞ্চলবাসী। ক’মাস আগেই কয়েক দফা বন্যায় দুর্ভোগের সীমা ছিল না তাদের। বন্যার পানি নেমে যাওয়ার পর ডুবে যাওয়া ঘরবাড়ি মেরামত করে আবারও ঘুরে দাঁড়িয়েছেন তারা।

বগুড়া সদর থেকে ২১ কিলোমিটার দূরে সারিয়াকান্দি উপজেলা। উপজেলার কালিতলা গ্রোয়েন বাঁধ থেকে পূর্ব দিকে খুব কাছে যে চরটি দেখা যাবে সেটি চরবাটিয়া। ইঞ্জিনচালিত নৌকায় মাত্র ৪ মিনিটেই সেখানে পৌঁছানো যায়। চরবাটিয়ার পরে ময়ুরের চর, কুড়িপাড়া চর, শালুখা চর, দারুনা চর, চর গজারিয়া।

সরেজমিনে এই চরগুলোতে গিয়ে দেখা গেছে, নদী শুকিয়ে যাওয়ায় যাতায়াত করতে কষ্ট হচ্ছে তাদের। ঘোড়ার গাড়ি, গরুর গাড়ি ছাড়া আর কোনো যানবাহন চলাচল করতে পারে না। চরাঞ্চলে উৎপাদিত কৃষিপণ্য, মালপত্র বহন এবং খুব প্রয়োজন ছাড়া এখানার মানুষ কেউ ঘোড়ার গাড়িতে উঠে না। তারা ঘণ্টার পর ঘণ্টা পায়ে হেঁটে ঘাটে যান। চরের মানুষগুলো দিনমজুরি, কৃষিকাজ আর মাছ শিকার করে জীবিকা নির্বাহ করেন। নদীতে পানি থাকলে মাছ শিকার আর জমিতে চাষাবাদ করার পর সংসারের অভাব লাঘব করতে তাদের অনেকেই নদীর এ পাড়ে আসেন দিনমজুরি করতে। কিন্তু ঘণ্টার পর ঘণ্টা পায়ে হেঁটে নদীর তীরে এসে নৌকার জন্য আরও দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষা করতে হয়। ফলে অনেকটা সময় নষ্ট হয় এসব শ্রমিকদের। এছাড়া, চরে হাসপাতাল না থাকায় চরম ভোগান্তির শিকার হতে হয় এখানকার মানুষদের। বেশি বিপদের সম্মুখীন হন প্রসূতি মায়েরা। বাড়িতে নরমাল ডেলিভেরিতে ব্যর্থ হওয়ার পর শেষ আশ্রয়স্থল হাসপাতালে ছুটতে হয় তাদের। কিন্তু যোগাযোগ ব্যবস্থা শোচনীয় হওয়ায় সময় মতো তারা হাসপাতালে পৌঁছাতে পারেন না। অনেক সময় প্রসূতি মায়ের মৃত্যুও ঘটে সময়মতো হাসপাতালে না পৌঁছাতে পারার কারণে। 

কুড়িপাড়া চরের বাসিন্দা মো. লেমন জানান, তিনি ২ বার ধানের জমি তৈরি করে চারা রোপন করেছিলেন। কিন্তু পরপর দুইবারই বন্যার কারণে জমি নষ্ট হয়ে যায়। পানি নেমে যাওয়ার পর ধান চাষের সময় থাকায় তিনি পুনরায় জমি তৈরি করে চারা রোপন করেন। কিন্তু ফলন ভাল হয়নি। ৭ বিঘা জমি থেকে তার ৭ মণ ধানও উঠবে না।

নদী শুকিয়ে গেলে অসুবিধার কথা জানিয়ে তিনি আরও জানান, তার বাড়ি থেকে আধা ঘণ্টারও বেশি সময় হাঁটার পর তিনি তীরে পৌঁছাতে পারেন। এরপর যদি ভাগ্য ভালো হয় তাহলে নৌকা সঙ্গে সঙ্গে পেয়ে যায়। আর না হলে দেড় দুই ঘণ্টা নদী পার হওয়ার জন‌্য অপেক্ষা করতে হয়। এছাড়া, চরবাসীদের মধ্যে কেউ অসুস্থ হলে ঘোড়ার গাড়ি অথবা সাঁই করে  (চৌকির চারপাশে রশি বেঁধে বাঁশ দিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়) ঘাটে নিয়ে যেতে হয়।

নিজ তিতপরল গ্রামের ঘোড়ার গাড়ি চালক মিন্টু জানান, তিনি কৃষি কাজ এবং ঘোড়ার গাড়ি দিয়ে মালপত্র বহন দুটোই করেন। শুষ্ক মৌসুমে ঘোড়ার গাড়ি চালিয়ে তার প্রতিদিন আয় হয় প্রায় ১২০০ টাকার মতো। ঘোড়ার খাবারের পেছনে তার প্রতিদিন খরচ হয় প্রায় ৪০০ টাকা। বর্ষাকালে যখন নদীতে পানি থাকে তখন ঘোড়ার গাড়ির আর প্রয়োজন হয় না।

সারিয়াকান্দি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা (আরএমও) জানান, আউটডোরে চর থেকে অনেক রোগী আসে সেগুলোর হিসাব রাখা সম্ভব হয় না। তবে এই মুহুর্তে ইনডোরে আমাদের ৫৪ জন রোগী আছে। এরমধ্যে চরের রোগী ১৮ জন। এখন নদীতে পানি শুকিয়ে যাচ্ছে। যে কারণে পানিবাহিত ও শীতের কারণে ঠাণ্ডাজনিত রোগী বেশি আসছে চর থেকে।

বগুড়া জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা (ভারপ্রাপ্ত) হজরত আলী জানান, বগুড়ায় শিক্ষার হার ৭৪ দশমিক ২৫ শতাংশ। সারিয়াকান্দি উপজেলায় শিক্ষার হার ৭৬ দশমিক ২৩ ভাগ। বর্ষায় শিক্ষার্থীরা নৌকায় যাতায়াত করলেও শুষ্ক মৌসুমে সাইকেল, ভ্যান অথবা পায়ে হেটে বিদ্যালয়ে যায়। বগুড়া জেলার মধ্যে সারিয়াকান্দি উপজেলায় শিক্ষার হার বেশি।

বগুড়া-১ (সারিয়াকান্দি-সোনাতলা) আসনের সংসদ সদস্য সাহাদারা মান্নান বলেন, ‘চর উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ আমাদের চলছে। ইতিমধ্যে বেশ কয়েকটি চরে বিদ্যুতের আলো পৌঁছে দেওয়া হয়েছে। এছাড়া, যেখানে বিদ্যুৎ দেওয়া যায়নি সেখানে সোলার বিদ্যুতের ব্যবস্থা করা হয়েছে। আসলে চরে পাকা রাস্তা করা যায় না। তারপরেও চরবাসীদের চলাচলের জন্য আরসিসি ঢালাই করা হয়েছিল। কয়েক বছর ভালো ছিলো। কিন্তু এবারের বন্যায় সেটি ভেঙে অর্ধেকের বেশি নদীর ভেতর চলে গেছে। চরবাসীর দুঃখ দুর্দশার কথা চিন্তা করে প্রয়াত এমপি আব্দুল মান্নান যেভাবে তাদের সহযোগিতা করেছেন, এখনও তাদের সেভাবেই সহযোগিতা করা হচ্ছে।’

এই বিভাগের অন্য খবর

Back to top button