অর্থ ও বানিজ্য

কৃষকরা সবজির ন্যায্য দাম পাচ্ছেনা

কৃষক সবজির ন্যায্যমূল্য পাচ্ছেন না। দেশব্যাপী সবজির বাম্পার ফলন হয়েছে। ফলে বাজারে সরবরাহে কোনো ঘাটতি নেই। লাভ দূরে থাক, উৎপাদন খরচ না ওঠায় নিদারুণ হতাশায় ভুগছেন তৃণমূল পর্যায়ের কৃষকরা। স্থানীয় বাজারে কৃষক এক কেজি মুলা বিক্রি করে পাচ্ছেন মাত্র দুই টাকা, সেই মুলা ঢাকায় বিক্রি হচ্ছে ১৫ থেকে ২০ টাকা।

কৃষকরা বলছেন, টমেটো, শিম, মুলা, লাউ, বাঁধাকপি, ফুলকপিসহ নানা ধরনের সবজি উৎপাদন করে লাভ তো দূরের কথা, উৎপাদন খরচও উঠছে না তাদের। এমনকি ক্যাপসিকাম ও লেটুসপাতাসহ অন্যান্য উচ্চমূল্যের সবজি চাষেও দাম মিলছে না। ফলে ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত হয়ে হতাশায় ভুগছেন তারা। বিশ্নেষকরা বলছেন, দাম না পেলে নতুন করে সবজি চাষে আগ্রহ হারাবেন তারা। পরবর্তী মৌসুমে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে বাজারে। এ জন্য সরকারকে কার্যকর উদ্যোগ নিয়ে সমস্যা সমাধান করা উচিত। তৃণমূল পর্যায়ে কৃষক সবজির প্রকৃত দাম না পেলেও ঢাকার বাজারে কয়েকগুণ বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে সেইসব সবজি। এতে মধ্যস্বত্বভোগীরাই প্রকৃত মুনাফা করছেন। ফলে সরবরাহ চ্যানেলে সংস্কার আনার জন্য গুরুত্ব আরোপ করেছেন বাজার বিশ্নেষকরা।

লাভের আশায় ধারদেনা করে সবজি চাষ করেন বহু কৃষক। এখন শ্রমিকের মজুরি দেওয়াই কষ্টসাধ্য হয়ে পড়েছে। উৎপাদন খরচ তুলতে না পারলেও ঢাকার বাজারে অবস্থা ভিন্ন। রাজধানীর সবজির পাইকারি ও খুচরা বাজারগুলোতে বেশ ভালো দামে সবজি বেচাকেনা হচ্ছে। গতকাল খুচরা বাজার ঘুরে দেখা যায়, প্রতি কেজি মুলা ১৫ থেকে ২০ টাকা, মিষ্টি কুমড়া ২০ থেকে ২৫ টাকা, কাঁচা টমেটো ও বেগুন ২০ থেকে ৩০ টাকা, শিম ৩০ থেকে ৪০ টাকা এবং প্রতিটি ফুল ও বাঁধাকপি ২০ থেকে ৩৫ টাকা ও লাউ ৪০ থেকে ৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। খুচরা বিক্রেতা শফিকুল ইসলাম বলেন, পাইকারি বাজারে সবজির দাম ওঠানামা করছে। একদিন কিছুটা কমলেও সপ্তাহের বাকি ছয় দিন বাড়তি দামে বিক্রি হয়। মোকামে কৃষকরা কম দামে বিক্রি করছেন- এমন শুনলেও ঢাকার আড়তে সেভাবে কম দামে পাওয়া যাচ্ছে না। তবে গত মাসের চেয়ে এ মাসে তুলনামূলক অনেক কম দামে সবজি বিক্রি হচ্ছে।

গতকাল রাজধানীর কারওয়ান বাজার ও মিরপুর-১ নং পাইকারি আড়তে প্রতি কেজি মুলা ৮ থেকে ১২ টাকায় বিক্রি হয়।

এ বাজারের চেয়ে কেজিতে ৫ থেকে ৮ টাকা বেশি দামে খুচরা বাজারে বিক্রি হয়। অথচ কৃষক তার বাজারে মাত্র দুই টাকা কেজিতে মুলা বিক্রি করছেন। পাইকারিতে প্রতি কেজি বেগুন ১৫ থেকে ২০ টাকা, মিষ্টি কুমড়া ১২ থেকে ১৬ টাকা, শিম ২০ থেকে ২৫ টাকা এবং প্রতিটি ফুল ও বাঁধাকপি ১৫ থেকে ২০ টাকা ও লাউ ২০ থেকে ৩০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, সবজির দামে একই চিত্র ফুটে উঠেছে।

পাইকারি ব্যবসায়ী মমিন মণ্ডল জানান, কারওয়ান বাজারে গত বৃহস্পতিবার রাতে সবজির বেশ ভালো দাম পেয়েছেন। তিনি জানান, বাজারে এখন সবজি আসছে প্রচুর। এতে দাম কমছে দ্রুত। এই বাজারের ব্যবসায়ী জুলফিকার আলী বলেন, বাজারে সবজির দামের ঠিক নেই। প্রতি মুহূর্তে ওঠানামা করছে। যখনই সবজির সরবরাহ বাড়ে তখন দাম কমে যায়। আবার যে সবজি কম আসছে, তার দাম একদিনেই কেজিতে ১০ টাকা ব্যবধান হচ্ছে। বাজারে দাম বেশি থাকলেও মোকামে কম কেন- জানতে চাইলে তিনি বলেন, কুড়িগ্রামের মোকামে দুই টাকা কেজি মুলা কিনলেও ঢাকায় আনতে ৭ থেকে ৮ টাকা খরচ হচ্ছে। এ কারণে ঢাকার আড়তে ৮ থেকে ১০ টাকা কেজিতে বিক্রি হচ্ছে।

গতকাল কারওয়ান বাজারে লাভের আশায় সরাসরি সবজি নিয়ে এসেছেন কৃষক আব্দুল বারেক। তিনি জানান, নীলফামারীর বাজারে ন্যায্যমূল্য না পেয়ে দিশেহারা তার মতো কৃষকরা। স্থানীয় বাজারে মুলার কেজি দুই টাকা, ফুলকপি পাঁচ টাকা ও বাঁধাকপি তিন থেকে চার টাকা কেজি। ক্ষেত খালি করতে এখন পানির দামে সবজি বিক্রি করছেন সেখানকার অনেকে। তিনি লোকসান এড়াতে ঢাকায় এসেছেন। তবে গাড়ি ভাড়া এবং পথে পথে খরচ গুনেও কিছুটা লাভে বিক্রি করতে পেরেছেন।

বগুড়া থেকে আমাদের নিজস্ব প্রতিবেদক মোহন আখন্দ জানান, বগুড়ার পাইকারি আড়তে শিম, মুলা, ফুল ও বাঁধাকপি কম দামে বিক্রি হচ্ছে। কমছে লেটুসপাতা এবং ক্যাপসিকামের দামও। আড়তদাররা বলছেন, যেসব সবজির আমদানি বেশি শুধু সেগুলোর দাম কমতির দিকে।


বগুড়ার সবচেয়ে বড় পাইকারি সবজির আড়ত মহাস্থান বাজারে গত সোমবার সকালে শিমের দাম সপ্তাহের ব্যবধানে মণে ৪০০ টাকা কমেছে। মুলার দাম মণপ্রতি ২০ থেকে ৩০ টাকা কমে ১০০ থেকে ১২০ টাকায় কেনাবেচা হয়েছে। এ হিসাবে এক কেজি মুলা আড়াই থেকে ৩ টাকা। আর ফুল ও বাঁধাকপির দাম মণপ্রতি ২৫০ থেকে ৩০০ টাকা দরে বিক্রি হয়েছে। এ হিসাবে কেজি সোয়া ছয় থেকে সাড়ে সাত টাকা।

মহাস্থান কাঁচামাল আড়তদার ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি বাবলু মিয়া জানান, বাজারে বর্তমানে আলু, শিম ও মুলার সরবরাহ বেড়েছে। ফলে এই সবজির দামও কমেছে। তার দেওয়া হিসাব অনুযায়ী, মহাস্থান বাজার থেকে রাজধানী ঢাকা ছাড়াও চট্টগ্রাম, নারায়াণগঞ্জ, গাজীপুর, খাগড়াছড়ি, বান্দরবান, কক্সবাজারসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় প্রতিদিন শতাধিক ট্রাক সবজি যায়। এর পরও আড়তে সবজির বাড়তি সরবরাহে দাম কমছে।
বগুড়ার শিবগঞ্জ উপজেলার ময়দানহাটা গ্রামের শৌখিন চাষি আনসার আলী জানান, লেটুসপাতাসহ বিদেশি সবজির দামও কমতির দিকে। তিনি জানান, গেল বর্ষা মৌসুমে যে লেটুসপাতা ৫০০ থেকে এক হাজার ২০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হয়েছে, সেগুলো এখন মাত্র ১০০ টাকায় কেনাবেচা হচ্ছে। ক্যাপসিকাম বিক্রি হচ্ছে ১২০ থেকে ২০০ টাকা কেজি দরে। অথচ কয়েক মাস আগেও তা বিক্রি হয়েছে ৩০০ থেকে ৩৫০ টাকা দরে। দাম কমে যাওয়ার কারণ জানতে চাইলে আনসার আলী জানান, কয়েক দফা বন্যায় ফসলহানির কারণে বর্ষা মৌসুমে উৎপাদন কম হয়েছিল বলে তখন দামও বেড়ে গিয়েছিল। কিন্তু এই শীতে লেটুসপাতা, ক্যাপসিকামসহ অন্যান্য বিদেশি সবজির আবাদ এবং ফলন দুটোই ভালো হয়েছে- যে কারণে দামও কমেছে।

কুড়িগ্রাম প্রতিনিধি মমিনুল ইসলাম মঞ্জু জানান, এই জেলার খুচরা বাজারে মূলা পাঁচ টাকা, পাইকারি বাজারে তিন টাকা এবং কৃষক পর্যায়ে আড়াই টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। আর বেগুন বিক্রি হচ্ছে খুচরা ২০ থেকে ২২ টাকা, পাইকারি ১৮ টাকা এবং কৃষক পর্যায়ে ১৪ থেকে ১৬ টাকা কেজিতে। ফুলবাড়ী উপজেলার নাওডাঙ্গা ইউনিয়নের কুরুসাফেরুসা গ্রামের কৃষক আবু বকর সিদ্দিক জানান, এবার দুই বিঘা জমিতে মূলা, দুই বিঘা জমিতে ফুলকপি এবং এক বিঘা জমিতে বাঁধাকপি আবাদ করেছেন। এর মধ্যে মুলা আবাদে খরচ হয়েছে ১০ হাজার টাকা। ক্ষেতে মূলার দাম প্রতি কেজি দেড় টাকায় নেমে আসায় লোকসানে পড়েছেন। কিন্তু চলতি সপ্তাহে মূলার দাম বেড়ে আড়াই টাকা কেজি হয়েছে।

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ দপ্তরের উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা আমিনুল ইসলাম জানিয়েছেন, জেলায় এ পর্যন্ত আলু ৫ হাজার ৫৬৫ হেক্টর, মূলা ৬০৬ হেক্টর, বাঁধাকপি ৪২৯ হেক্টর, ফুলকপি ৪৬২ হেক্টর এবং বেগুন এক হাজার ২২ হেক্টর জমিতে আবাদ হয়েছে।

এই বিভাগের অন্য খবর

Back to top button