নব্যদীপ্তি_শুদ্ধ চিন্তায় তারুণ্য

বিজয়াদের বিজয়কথন

বাংলাদেশে ডিসেম্বর মানেই বিজয়ের মাস, চারদিকে বিজয়ের উৎসব। প্রতিবছর পুরো মাসব্যাপী বিভিন্ন কর্মসূচি, সভা-সমাবেশ, দোয়া মাহফিল ও শহীদদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জ্ঞাপন-এর মধ্য দিয়ে পালিত হয় বিজয় দিবস।
এই বিজয় অর্জন করতে আমাদের কম ত্যাগ স্বীকার করতে হয়নি। লোমহর্ষক এক গণহত্যার সাক্ষী হতে হয় দেশকে। ৩০ লাখ নর-নারী শহীদ হয়। নির্বিচার ধর্ষণ, লুট, অগ্নিসংযোগ ও ধ্বংসযজ্ঞের শিকার হয় আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি। উত্তর আসে চূড়ান্ত বিজয়, আমাদের কাঙ্ক্ষিত সেই অর্জন।

এই বিজয় অর্জনে নারীর অবদান ছিল কতটুকু? ধর্ষণ, নিপীড়ন, লাঞ্ছনা, অত্যাচার ও সহিংসতার শিকার হয়েও তখন নারীসমাজ লড়াই করেছে। দেশের ভেতরে মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় দিয়েছে, রক্ষা করেছে। রণাঙ্গনে দাঁড়িয়েও বিপুল বিক্রমে লড়েছেন নারীরা।
তথ্যসূত্রানুযায়ী, যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ও তাদের সহযোগী বাহিনীর সদস্যরা দুই থেকে চার লক্ষ বাঙালি নারীকে ধর্ষণ করে। সেই ধর্ষণের নৃশংসতা তুলে ধরতেই একটি উদাহরণঃ
“২৭ মার্চ,১৯৭১,ঢাকা মিটফোর্ড হাসপাতালের লাশ ঘর থেকে লাশ ট্রাকে তুলতে গিয়ে একটি চাদর ঢাকা ষোড়শী মেয়ের লাশ দেখতে পান পরদেশী। সম্পূর্ণ উলঙ্গ লাশটির বুক এবং যোনিপথ ছিল ক্ষতবিক্ষত, নিতম্ব থেকে টুকরো টুকরো মাংস কেটে নেয়া হয়েছিল। ২৯ মার্চ শাখারীবাজারে লাশ তুলতে গিয়ে পরদেশী সেখানকার প্রায় প্রতিটি ঘরে নারী, পুরুষ,আবাল বৃদ্ধ বনিতার লাশ দেখতে পান, লাশগুলি পচা এবং বিকৃত ছিল। বেশিরভাগ মেয়ের লাশ ছিল উলঙ্গ,কয়েকটি যুবতীর বুক থেকে স্তন খামচে, খুবলে তুলে নেয়া হয়েছে, কয়েকটি লাশের যোনিপথে লাঠি ঢোকান ছিল। মিল ব্যারাকের ঘাটে ৬ জন মেয়ের লাশ পান তিনি ,এদের প্রত্যেকের চোখ, হাত, পা শক্ত করে বাঁধা ছিল, যোনিপথ রক্তাক্ত এবং শরীর গুলিতে ঝাঝরা ছিল।”
– ডোম পরদেশী।

এটি বানানো কোনো হরর কাহিনী নয় বরং এই বাংলাদেশ জন্মানোর পেছনে যে ইতিহাস তার একটি ক্ষুদ্রাংশ মাত্র। এতো ভয়াবহতা ও নৃশংসতা চোখের সামনে দেখেও নারীরা আত্মসমর্পণ করেননি, পালিয়ে যাননি যুদ্ধক্ষেত্র থেকে। বরং প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে নিজেদেরকে স্বাধীনতাযুদ্ধের অংশীদার করেছেন। ছিনিয়ে এনেছেন বিজয়। এজন্যই তো নারীরা বিজয়া, নারীরা বীরাঙ্গনা।

স্বাধীনতাযুদ্ধ ১৯৭১ সালে শেষ হলেও নারীদের জন্য যুদ্ধ কিংবা বিজয় অর্জনের সংগ্রাম এখনো কিন্তু শেষ হয়নি। স্বাধীনতার এই ৪৯ বছরে বহু নারীর জীবনযুদ্ধ বিজয়ের সাক্ষী হয়ে আছে আমাদের বাংলাদেশ।

১৯৯৬ সালের ১৪ই সেপ্টেম্বর। শামিমা নামক ১৪ বছর বয়সী এক মেয়ের উপর এসিড হামলা চালায় এক নরপশু। শামিমা বলে, “আমি এখন আর আয়না দেখিনা, কিন্তু যখনই আমি আমার নাক অথবা কান স্পর্শ করি তখনই আমার মনের আয়নায় ভেসে ওঠে ওই দৃশ্য।” তারপরেও শামিমা হেরে যাননি তার জীবনযুদ্ধে বরং লড়াই করেছেন নিজেকে টিকিয়ে রাখার জন্য। এই জীবনযুদ্ধে তিনি একজন বিজয়া।

বর্তমানে এসিড নিক্ষেপের মতো ভয়াবহ ঘটনার হার অনেকটা কম হলেও একসময় এই ভয়াবহতা চরম পর্যায়ে। এসিড সারভাইভাল ফাউন্ডেশনের হিসাবে, ১৯৯৯ সাল থেকে বাংলাদেশে ৩ হাজারেরও বেশি এসিড হামলার ঘটনা ঘটেছে। এমন ভয়াবহ হামলার শিকার সেসব নারী যারা জীবনযুদ্ধে হেরে না গিয়ে আবারও ঘুরে দাঁড়িয়েছেন তারা প্রত্যেকেই একেকজন বিজয়া।

সাল ২০১৭। আমার খুব কাছের এক বন্ধুর বড়বোনের সাথে ঘটে যাওয়া ঘটনা। আপু তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী ছিলেন। প্রেমিকের ঘুরতে গিয়ে প্রেমিক ও তার দুই বন্ধুর দ্বারা গণধর্ষণের শিকার হতে হয়েছিল তাকে। অর্ধমৃত অবস্থায় কেউ তাকে হাসপাতালে ভর্তি করেছিল এবং সেখান থেকেই শুরু হয় তার যুদ্ধ। মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে এসে সমাজে টিকে থাকার জন্য লড়াই করে গেছেন নিজের মনোবল ও দৃড়তার সাথে। অপরাধীদের যোগ্য শাস্তির ব্যবস্থাও করেছিলেন। হার না মানা এই নারীর বর্তমানে পরিচিত একজন সফল নারী উদ্যোক্তা হিসেবে। টিকে থাকার যুদ্ধে তিনিও একজন বিজয়া।

আমাদের আশেপাশে এরকম অসংখ্য বিজয়াদের গল্প আমরা প্রতিনিয়তই দেখি বা শুনি। শুধু সমাজ কিংবা বাইরের মানুষ না বরং নিজের বাবা-মা, ভাই-বোন, স্বামী-সন্তান, আত্মীয় বা পরিজনদের দ্বারাও অত্যাচারিত এবং লাঞ্চিত হওয়ার পরেও যেসব নারী বারবার ঘুরে দাঁড়ান সাহসিকতার সাথে, তারা প্রত্যেকেই একজন বিজয়া।

এই বিজয় দিবস উৎসর্গিত হোক সেসব বিজয়াদের প্রতি যারা হেরে গিয়ে নয় বরং লড়াই করে বেঁচে আছেন। নিজেদেরকে এগিয়ে নিয়েছেন সকল বাধা-বিপত্তি ও সমাজের কটুক্তি উপেক্ষা করে।
এই বিজয় দিবস উৎসর্গিত হোক সেসব জীবন্ত বিজয়াদের প্রতি যারা প্রত্যেকে একটি জলন্ত উদাহরণ “আমরা নারী, আমরাই পারি”-উক্তিটির। সেইসাথে কামনা নারীদের জন্য জীবন নামক যুদ্ধক্ষেত্র যেনো এতটা কঠিন না হয়। এই সমাজ যেনো নারীদের প্রতি আরো কিছুটা সদয় হয় কারণ যুদ্ধে নামা সকলেই কিন্তু বিজয়া হয়ে ফিরেনা কেউ কেউ শহীদ ও হয়।

তাসনিয়া তাসনিম শ্রুতি
নব্যদীপ্তিশুদ্ধচিন্তায়_তারুণ্য

এই বিভাগের অন্য খবর

Back to top button