জাতীয়

করোনাকালে শিশুদের মোবাইল আসক্তি, আমাদের করণীয়

সুন্দর সুস্থ-সবল এই পৃথিবীটা হঠাৎ করে যেন অসুস্থ হয়ে উঠলো। হঠাৎ করে আবিভূর্ত হলো এক মহামারী। মুহূর্তের মধ্যেই তছনছ করে দিল চতুর্দিক। ডিসেম্বরের শেষ থেকে জানুয়ারীর মাসের কথা, যখন সবাই খবরে দেখতো চীনে এক মহামারী এসেছে এবং বিনাশ করছে মানুষদের প্রাণ, তখন আমাদের সকলের কল্পনায় আসেনি যে, এই মহামারী আমাদের এই সুন্দর সুজলা-সফলা শস্য-শ্যমলা দেশে হানা দেবে একদিন।

দেখতে দেখতে খুব কম সময়ের ব্যবধানেই মার্চ মাসে আমাদের দেশেও দেখা দিলো করোনার প্রকোপ। সেই মার্চ থেকে শুরু করে এখন পর্যন্ত চলছে করোনার ভয়াবহতা। সামনে আর কতদিন এরকম চলবে আমরা কেউ বলতে পারি না। সারা বিশ্বে এই মহামারী ভয়বহ আকার ধারণ করেছে। কেড়ে নিচ্ছে অজস্র প্রাণ। করোনাকালীন এই সময়ে মানুষের জীবনে এসেছে অনেক বৈচিত্র্য। করোনা কারো জীবনে ইতিবাচক দিক হিসেবে বিবেচিত হলেও অধিকাংশ মানুষের জীবনেই এটি কাল হয়ে এসেছে। করোনায় অনেকে হারিয়েছে সর্বস্ব। মানুষের জীবনধারায় এসেছে এক বিরাট পরিবর্তন। করোনায় নেতিবাচক কয়েকটি বিষয়ের একটি হলো শিশুদের মোবাইল ফোনের প্রতি আসক্তি বেড়ে গিয়েছে।

ইন্টারনেটের এই যুগে সবার হাতে হাতে এন্ড্রয়েড মোবাইল। মানুষ খবর থেকে শুরু করে নাটক, চলচ্চিত্র, খেলা সবকিছু টিভির চেয়ে এখন মোবাইলে দেখতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। আগের মতো পরিবারের সকলে একসাথে বসে কোন অনুষ্ঠান দেখা আর হয়ে উঠে না। একটা সময় ছিল যখন মানুষ পরিবারের ছোট শিশু সহ সকলকে সাথে নিয়ে বসে’ ইত্যাদি’, মিনা কার্টুন’, ‘সিসিমপুর’, খেলাধূলা, বা বিভিন্ন প্রতিযোগিতামূলক অনুষ্ঠান দেখতো। এখন আর এরকম দিন নেই। এখন মানুষ অনলাইনে সময় কাটাতে বেশি পছন্দ করে। করোনার এই সময়ে মানুষের মোবাইল ব্যবহার বহুগুণে বৃদ্ধি পেয়েছে। এটা একদিকে যেমন বড়দের ওপর খারাপ প্রভাব ফেলছে তেমনি ছোট শিশুদের ওপরেও খারাপ প্রভাব ফেলছে।

দৈনিক সমকালে রওশন আক্তার ঊর্মির এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, ইউনিসেফের তথ্য অনুসারে বিশ্বে প্রতি তিনজন ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর একজন শিশু। আর প্রতিদিন এক লাখ ৭৫ হাজার অর্থাৎ প্রতি আধা সেকেন্ডে একজন শিশু নতুন করে ইন্টারনেটের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে। ফেসবুক ব্যবহারকারীদের ২৫ শতাংশের বয়সই ১০ বছরের কম।

একটি শিশু যদি সর্বক্ষণ পরিবারের মানুষদের মোবাইল, ট্যাব ব্যবহার করতে দেখে তাহলে খুব স্বাভাবিকভাবেই তার সে জিনিসের প্রতি আকর্ষণ বাড়বে। এই আকর্ষণ থেকে তারাও মোবাইল ব্যবহারে আসক্ত হয়ে পড়ছে । শিশুর জেদ সামাল দিতে পরিবারের মানুষজনও তাদের হাতে মোবাইল তুলে দিচ্ছে। অনেক অভিভাবক শিশুর এই মোবাইল আসক্তিকে “যুগের সাথে তাল মিলিয়ে চলা” হিসেবে গণ্য করছেন। কিন্তু তারা কল্পনাও করতে পারছেন না শিশুর এই আসক্তি ভবিষ্যতে কি ধরণের বিপত্তিতে ফেলতে পারে।

টাইমস অব ইন্ডিয়ার এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, ৬৫% শিশু করোনার এই সময় ইলেকট্রনিক ডিভাইসের প্রতি আসক্তি।

কিছুদিন আগে কথা হয়েছিল এক মায়ের সাথে। তিনি জানালেন তার ছোট মেয়ে মেহজাবিন। বয়স প্রায় ৭ বছর। বিদ্যালয়ে ভর্তি হবার প্রস্তুতি চলছিল। করোনার প্রাদুর্ভাব হওয়াতে বর্তমানে তা থেমে আছে। করোনার আগে বাসার নিচে নিয়মিত খেলতো সে। মহামারীর এই সময়ে তার আর খেলা হয় না। বাসায় একা একা খেলতে ভালো লাগে না তার। বাবা মা দুজনই কর্মজীবী। বাবা বাসা থেকে অফিস করে, মাকে নিয়মিত যেতে হয় বাইরে। তার মা জানালো, একটা সময় মেহজাবিন মোবাইল বা ট্যাবে কার্টুন ভিডিও দেখে দেখে খাবার খেতো। হাতে মোবাইল না দিলে খেতো না। খুব কষ্টে স্বামী-স্ত্রী মিলে তাকে সেই নেশা থেকে বের করে এনেছে। বাসার নিচে খেলবার সুযোগ থাকাতে সে আর এসব ডিভাইস হাতে নিতো না। কিন্তু করোনা আসার পর থেকে তার বাসার নিচে গিয়ে খেলবার সুযোগটাও বন্ধ হয়ে গেছে। এখন বাসায় সবাই বন্দী দশা পার করছে। আর এই সুযোগে সে নতুন করে মোবাইলের নেশায় আসক্ত হয়েছে, যা সামাল দেওয়া স্বামী-স্ত্রী দুজনের জন্যই কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। সারাবিশ্বেই শিশুদের মোবাইল বা ইলেকট্রনিক ডিভাইসের ব্যবহার দিন দিন অতুলনীয়ভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে।

২০১৯ সালে গার্ডিয়ান নিউজপেপার কমনসেন্স মিডিয়ার একটি রিপোর্ট প্রকাশ করে। সে রিপোর্ট অনুযায়ী, যুক্তরাষ্ট্রের ৫৩% ১১ বছর বয়সী বাচ্চাদের স্মার্টফোন আছে। ১২ বছর হতে হতে এই সংখ্যা ৬৯% এ গিয়ে দাঁড়ায়। আমাদের দেশের বাচ্চারাও তার ব্যতিক্রম নয়। বর্তমান সময়ে করোনা পরিস্থিতিতে এই সংখ্যা যেন দিন দিন বাড়ছে।

আমিরিকান কমিউনিটি সারভে অনু্যায়ী ২০১৮ সালে ৯৪% ৩ থেকে ১৮ বছর বয়সী বাচ্চাদের বাসায় ইন্টারনেট ব্যবহারের সুযোগ ছিল। এর মধ্যে ৮৮% কম্পিউটারের মাধ্যমে এবং ৬% স্মার্টফোনের মাধ্যমে ইন্টারনেট ব্যবহার করতো। যত দিন এগুচ্ছে এ সংখ্যা তত বৃদ্ধি পাচ্ছে। বর্তমান সময়ে অনলাইন ক্লাস, পরীক্ষার সুবাদে বাচ্চারা এই ইন্টারনেট ব্যবহারের সুযোগ বেশি পাচ্ছে এবং এতে আসক্তও হয়ে পড়ছে। -স্বাধীন বাংলা

এই বিভাগের অন্য খবর

এছাড়াও দেখুন
Close
Back to top button