জাতীয়

১৩ কিলোমিটার রাস্তায় দমবন্ধ পরিস্থিতি

ঢাকার বিমান বন্দর থেকে গাজীপুর চৌরাস্তা পর্যন্ত ১৩ কিলোমিটার রাস্তায় শুধু ধুলা আর ধুলা। কয়েক স্তরের ধুলায় রাস্তা দিয়ে হাঁটলে সুস্থ থাকা দায়। ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাড়কের বিশাল অংশ জুড়ে ধুলায় দমবন্ধ পরিস্থিতি দীর্ঘদিনের। রাজধানীর বিমানবন্দর থেকে গাজীপুর পর্যন্ত বাস র‌্যাপিড ট্রানজিট (বিআরটি) প্রকল্পের কাজ চলছে। আর উত্তরায় চলছে মেট্রোরেল ও এক্সপ্রেসওয়ের নির্মাণ কাজ। এসব কর্মযজ্ঞের উদ্দেশ্যই নির্বিঘ্ন ও দ্রুতগতির পরিবহন ব্যবস্থা নিশ্চিত করা। কিন্তু দ্রুত পরিবহন ব্যবস্থাপনার প্রকল্পগুলোর ধীরগতিতে রাস্তাসহ আশ-পাশের দোকানপাট, ভবন, বাসা-বাড়ি সবই বিষাক্ত ধুলার আস্তরে ঢাকা। সরকারের অগ্রাধিকার এ প্রকল্পের করুণ দশায় রীতিমতো ধুঁকছে মানুষ।

ঢাকার প্রবেশমুখে যানজট কমাতে গাজীপুর থেকে বিমানবন্দর পর্যন্ত সাড়ে ২০ কিলোমিটার দীর্ঘ বাস র‌্যাপিড ট্রানজিট (বিআরটি) চালুর সিদ্ধান্ত হয়। এজন্য ২০১২ সালের ডিসেম্বরে গ্রেটার ঢাকা সাসটেইনেবল আরবান ট্রান্সপোর্ট প্রজেক্ট (বিআরটি, গাজীপুর-বিমানবন্দর) অনুমোদন করে সরকার। তবে আট বছরে প্রকল্পটির বাস্তবায়ন হয়েছে মাত্র ৩৪ দশমিক ৪৫ শতাংশ। গাজীপুর-বিমানবন্দর বিআরটি নির্মাণে প্রাথমিকভাবে ব্যয় ধরা হয়েছিল দুই হাজার ৩৯ কোটি ৮৫ লাখ টাকা। পরে তা বেড়ে হয়েছে চার হাজার ২৬৮ কোটি ৩২ লাখ টাকা। তবে ডিজাইন সংশোধনের কারণে এ ব্যয় পাঁচ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

জানা গেছে, প্রকল্পটির পরিকল্পনায় এক দফা সংশোধন আনা হয়েছে। এরপরও প্রকল্পটির ডিজাইন ও স্পেসিফিকেশন নিয়ে নতুন জটিলতা দেখা দিয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম হলো, এলিভেটেড অংশের ডিজাইন। এ অংশে অত্যাধিক যান চলাচলের কারণে বক্স গ্রিডার নির্মাণ সম্ভব নয় বলে জানিয়েছে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। এজন্য বক্স গ্রিডারের পরিবর্তে আই গ্রিডার করতে হচ্ছে এলিভেটেড সাড়ে চার কিলোমিটার অংশ। পাশাপাশি হযরত শাহজালাল (রা.) আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে বিমানবন্দর রেলস্টেশন পর্যন্ত যাত্রী পারাপারে আন্ডারপাস নির্মাণ নতুন করে প্রকল্পটিতে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। এছাড়া প্রকল্পের আওতায় নির্মাণাধীন টঙ্গী-জয়দেবপুর সড়কের কারিগরি ডিজাইন পরিবর্তন করতে হবে। এতে প্রকল্পটির ব্যয় বেড়ে যাবে। তবে এর আগেও প্রকল্পের ত্রুটি সংশোধনের যুক্তিতে ব্যয় বেড়েছিল দুই হাজার ২২৮ কোটি ৪৭ লাখ টাকা।

ভুক্তভোগিরা জানান, ঢাকার বিমান বন্দর থেকে গাজীপুর চৌরাস্তা পর্যন্ত ১৩ কিলোমিটার রাস্তা এখন বিষফোঁড়া হয়ে উঠেছে। ধুলায় চোখেও কিছু দেখা যায় না। একই অভিযোগ স্থানীয় বাসিন্দাদের। টঙ্গীর মিতালী ফিলিং স্টেশনের কাছে মোবারক নামে একজন দোকানি বলেন, মাসের পর মাস ধরে ধুলার যন্ত্রণা, দোকানের সামানের অংশ ঢেকে রেখেও রক্ষা পাচ্ছি না। দোকানদারি করে হাঁপানির রোগী হয়ে গেছি। ধুলার কারণে কাস্টমারও আসে না। বেচাকেনা নেই বললেই চলে।

এদিকে, বায়ুমান সূচক অনুযায়ী, ঢাকা ও ঢাকার আশপাশের এলাকায় বায়ুদূষণ ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। গতকাল সোমবারও দিল্লিকে পেছনে ফেলে বায়ু দূষণে রাজধানী ঢাকা এক নম্বরে স্থান করে নিয়েছে। বায়ুদূষণ নিরসনে গত বছরের ২৮ জানুয়ারি উচ্চ আদালত নির্দেশানমূলক রায় দেন। এরপর নানা সময় এ রায় কার্যকর নিয়ে তদারকিমূলক বিভিন্ন নির্দেশনা দেওয়া হয়। উচ্চ আদালত যাদের কারণে রাজধানীতে বায়ুদূষণ হচ্ছে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে সপ্তাহে দুইবার ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করতে পরিবেশ অধিদপ্তরের মহাপরিচালককে নির্দেশ দেন। একই সঙ্গে ঢাকার যেসব এলাকায় উন্নয়ন ও সংস্কারকাজ চলছে সেসব এলাকা (কাজের স্থান) ঘেরাও করে কাজ করার পদক্ষেপ নিতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি উন্নয়ন ও সংস্কারকাজের কারণে ধুলাবালিপ্রবণ এলাকায় ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে দিনে দুইবার পানি ছিটাতে ঢাকার দুই সিটি মেয়র ও নির্বাহীদের নির্দেশ দেওয়া হয়। উন্নয়নকাজের এলাকায় প্রয়োজনে দুই বেলা পানি ছিটানোর কথা থাকলেও বিআরটি প্রকল্পের ১৩ কিলোমিটার এলাকায় স্থানীয়রা কখনো পানি ছিটাতে দেখেননি বলে জানান। ঢাকা-গাজীপুর রুটে চলাচলকারী ঢাকা পরিবহনের চালক ফরহাদ হোসেন বলেন, গাড়ির গতি বাড়লে ধুলা ওড়ার গতিও বাড়ে। এলাকা অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে পড়ে। যাত্রীরাও ধুলায় ধূসর হয়ে যায়। অনেক সময় দিনের বেলায়ও হেডলাইট জ্বালাতে হয়।
এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক বায়ুমান বিশেষজ্ঞ প্রফেসর আবদুস সালাম বলেন, উন্নয়নকাজের ক্ষেত্রেও নিয়ম-নীতি মানা হচ্ছে না। ধুলার জন্য পানি ছিটানোর কথা। কিন্তু তা হয় না। সড়ক খোঁড়াখুঁড়ির পর মাটি অন্যত্র সরিয়ে নেওয়ার কথা। তা না করে সড়কেই ফেলে রাখা হয়। মাটি শুকিয়ে ধুলি হয়ে বাতাসে ওড়ে। জনবহুল এলাকায় সড়কের কাজ দ্রুত করার কথা। কিন্তু ঠিকাদার কাজ ফেলে রাখেন।

বিআরটি প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক এ এস এম ইলিয়াস হোসেন জানান, দ্রুতই সড়কে ধুলা নিবারণের জন্য পানি ছিটানোর ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। পরিবেশ অধিদপ্তর, গাজীপুর জেলার উপপরিচালক আবদুস সালাম সরকার বলেন, বিআরটি সরকারের অগ্রাধিকারভিত্তিক একটি উন্নয়ন প্রকল্প। বায়ুদূষণ রোধের জন্য প্রকল্পে ব্যয় ধরা আছে। বিপজ্জনক মাত্রায় বায়ু ও শব্দদূষণের অভিযোগ পাওয়ায় বিআরটি প্রকল্পের ঠিকাদারদের সতর্ক করা হয়েছে। তারপরও পরিস্থিতির উন্নতি হয়নি। বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের জানানো হবে।

বিআরটি প্রকল্প সূত্র জানায়, স¤প্রতি অনুষ্ঠিত বিআরটি প্রকল্পের স্টিয়ারিং কমিটির বৈঠকে জানানো হয়, বিআরটি প্রকল্পের বর্তমান ব্যয় বর্তমানে চার হাজার ২৬৮ কোটি ৪৩ লাখ টাকা। এর মধ্যে গত জুন পর্যন্ত ব্যয় হয়েছে মাত্র এক হাজার ১৮৯ কোটি ৯৮ লাখ টাকা বা ২৯ দশমিক ৪৩ শতাংশ অর্থ। তবে প্রকল্পটির ঋণচুক্তির মেয়াদ আগামী ৩১ ডিসেম্বর শেষ হয়ে যাবে। তাই এ চুক্তির মেয়াদ বাড়াতে হবে। বৈঠকের তথ্যমতে, প্রকল্পটির সাড়ে চার কিলোমিটার ছয় লেনবিশিষ্ট এলিভেটেড অংশ রয়েছে। পাশাপাশি আরও সাড়ে চার কিলোমিটার অ্যাট গ্রেড (মাটিতে) সড়ক, ১০ লেনবিশিষ্ট টঙ্গী সেতু ও ছয়টি বিআরটি স্টেশন নির্মাণ করছে সেতু বিভাগ। পরামর্শক প্রতিষ্ঠান এলিভেটেড অংশের ডিজাইন করেছে ২০১৫ সালে। আর ঠিকাদার নিয়োগ করা হয় ২০১৭ সালের ১৯ অক্টোবর।

সাড়ে চার কিলোমিটার এলিভেটেড অংশে আটটি র‌্যাম্প ও ১৬৩টি স্প্যান রয়েছে। এর মধ্যে ৭৮টি স্প্যান আই গ্রিডার ও ৮৫টি বক্স গ্রিডার। টঙ্গী থেকে গাজীপুর পর্যন্ত সড়কটি অত্যন্ত ব্যস্ত করিডোর। প্রায় ২১টি জেলার সঙ্গে এই করিডোর যুক্ত। ২০১৪ সালের সার্ভে ডেটার ভিত্তিতে প্রতিদিন এ রুটে উভয় দিকে ৩৬ হাজার থেকে ৪৪ হাজার যানবাহন চলাচল করত। বর্তমানে এ রুটে ৬০ হাজার গাড়ি চলাচল করে। এমন ব্যস্ত একটি সড়কে যান চলাচল অব্যাহত রেখে বক্স গ্রিডার স্থাপন অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ বলে অভিহিত করে শুরু থেকে চিঠি দেয় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। এর পরিপ্রেক্ষিতে স¤প্রতি ঠিকাদার বক্স গার্ডারের পরিবর্তে আই গার্ডারের মাধ্যমে ওই অংশ নির্মাণের প্রস্তাব জমা দেয়। এতে ৪১ কোটি টাকা ব্যয় সাশ্রয় হবে বলেও জানানো হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে গত ১ সেপ্টেম্বর বক্স গ্রিডার এলিভেটেড অংশটি আই গ্রিডার নির্মাণের অনুমতি দেওয়া হয়।

জানা গেছে, প্রাথমিকভাবে প্রকল্পটির মেয়াদ ছিল ২০১৬ সালের নভেম্বর। পরে তা কয়েক দফা বৃদ্ধি করা হয়। এতে গত জুনে প্রকল্পটির কাজ শেষ করার কথা ছিল। তবে এখনও প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ কাজ বাকি থাকায় স¤প্রতি এ মেয়াদ আরও দুই বছর বাড়িয়ে ২০২২ সালের জুন পর্যন্ত করা হয়েছে। এ বিষয়ে সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের সচিব মো. নজরুল ইসলাম বলেন, বিআরটি প্রকল্পে বেশকিছু বিষয়ে সংশোধন আনা হয়েছে। স্টিয়ারিং কমিটির সভায় এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে প্রকল্পটি সংশোধনের নির্দেশনাও দেওয়া হয়েছে।

এই বিভাগের অন্য খবর

Back to top button