তারুণ্যের কন্ঠস্বরমুক্তিযুদ্ধ বগুড়া

মুক্তিযুদ্ধে অনন্য বগুড়া – আকবর আহমেদ

মহান স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে আজকের বিশেষ প্রতিবেদন

মুক্তিযুদ্ধে অনন্য বগুড়া

লেখকঃ আকবর আহমেদ (সহঃ সম্পাদক – বগুড়া লাইভ)

আমার ক্ষুদ্র জ্ঞ্যানে বগুড়ার মুক্তিযুদ্ধের শুরুর দিকের কিছু ইতিহাস খুবই অনন্য মনে হয়েছে। আমি এখানে মাত্র সাতটি বিষয়ে আলোকপাত করবো, যা আমার স্বল্প জ্ঞ্যানে মনে হয়েছে অত্যন্ত উল্লেখযোগ্য। যা থেকে পরবর্তী বগুড়ার মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক জ্ঞ্যানপিপাষুরা গবেষনার সূত্র পেতে পারেন। অনেক কথাই এখানে বলবো না, কারন, সেগুলো অনেকেই জানেন। আবার এমনও না যে, নিচের ইতিহাসগুলো কেউ জানেন না। কষ্ট করে পড়বেন এবং সমালোচনা করবেন।

● প্রথমতঃ আমি আনত সালাম জানাতে চাই জনাব মাছুদার রহমান হেলাল সাহেবকে। ঐতিহাসিক ৭ই মার্চে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বঙ্গবন্ধুর ভাষণের পর বগুড়া শহর মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। সব জায়গায় আলোচনা চলছিল-“যুদ্ধ হবে, প্রস্তুত হও”। তৎকালীন সময়ের ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতৃবৃন্দের নেতৃত্বে প্রতিটি মহল্লায় “ছাত্র বিগ্রেড” এর কমিটি গঠন হয়। সেই “ছাত্র বিগ্রেড” এর আহ্বানে প্রতিদিন বিকেল বেলা জিলা স্কুল মাঠে ছাত্র-ছাত্রীরা সমবেত হত এবং ট্রেনিং নিতো। সেই “ছাত্র বিগেড” এর দায়িত্বে ছিলেন এই মাছুদার রহমান হেলাল।

● দ্বিতীয়তঃ আমি সশ্রদ্ধ স্যালুট জানাতে চাই তৌফিকুল আলম টিপু সাহেবকে। তাঁর নেতৃত্বে তার দল সাতমাথায় নির্মানাধীন সপ্তপদী মার্কেটের দোতলায় প্রায়ই বিকেল বেলা করে করে স্বাধীনতার গান, গণসঙ্গীত, বিপ্লবী গান গেয়ে লোকজনকে উদ্দীপ্ত করতেন। ট্রাকে করে শহরের বিভিন্ন স্থানে এমনকি গ্রামে গিয়ে এসব গান গেয়ে মানুষকে উৎসাহিত করতেন। আমি নিশ্চিৎ, তাঁদের সাথে লিয়ার লেভিনের মতো কেউ থাকলে আর একটি “মুক্তির গান” এর জন্ম হতো।

● তৃতীয়তঃ আমি শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করতে চাই চিশতি শাহ হেলালুর রহমান সাহেবকে। আমার জানা মতে তিনিই ঢাকাস্থ প্রথম বগুড়ার শহীদ। চিশতি শাহ হেলালুর রহমানের পৈতৃক নিবাস বগুড়া শহরের রহমান নগর। ২৬ মার্চ সকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এর ইকবাল হলে দৈনিক আজাদ পত্রিকার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি ছিলেন চিশতি শাহ হেলালুর রহমান। থাকতেন সার্জেন্ট জহুরুল হক হলে (তখন নাম ছিলো ইকবাল হল)। ছাত্র রাজনীতির সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন। হল ছাত্র সংসদের পাঠাগার সম্পাদক ও বিশ্ববিদ্যালয় সাংবাদিক সমিতির সহ-সভাপতি নির্বাচিত হয়েছিলেন। একাত্তরের ২৬ মার্চ সকালে পাকিস্তানি সেনারা তাঁকে নির্মমভাবে হত্যা করে। তাই আমি তাঁকে ঢাকাস্থ প্রথম বগুড়ার শহীদ বলি।

● চতুর্থতঃ আমি স্মরণ করতে চাই, বগুড়ার প্রথম শহীদ তোতা মিয়া কে। এই তথ্য যদিও সবাই জানেন। তবে এখানে উল্লেখ করার উদ্দেশ্য, অন্য। সবাই জানেন এবং লেখেন, “শহীদ তোতা মিয়া একজন রিক্সাচালক ছিলেন।“ কিন্তু, না। উনি রিক্সাচালক ছিলেন না। উনি ছিলেন একজন “ট্রাক ড্রাইভার”। হয়তোবা, সামাজিক অবস্থানগত দিক দিয়ে এ দুই পেশার মধ্যে খুব বেশি সম্মানের তারতম্য ছিলো না। তবুও আমার দৃষ্টিতে “ভুল” ভুলই। বগুড়ার মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের শুরুর ইতিহাসে একটি “ভুল” থাকবে, তা আমি কোন ভাবেই মানতে চাই না।

● পঞ্চমতঃ সারাদেশে অনেক যায়গায় রেল লাইনে ব্যারিকেড দেওয়ার কথা আমরা জানি। কিন্তু বগুড়ায় রেল ব্যারিকেড দেওয়া একটি বিশেষ তাৎপর্য বহন করে। কারন, এই রেল ব্যারিকেড পার হয়ে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী বগুড়া শহরে প্রবেশ করতে পারেনি। এই ব্যারিকেড পার হলেই বগুড়া শহরের পতন হয়ে যেতো। এই ব্যারিকেড দেওয়ার মূল নেপথ্যে ছিলো আব্দুর রশীদ শেখ (রশীদ), মো: আবু হেনা ফিরোজ, রুমি, তোতা, মীর নজরুল ইসলাম (নজু), হেদায়েত আলী (টিপু), সাইফুল ইসলাম (আলম), মো: রেজাউল করিম (মিলন) ও মাসুদ আলমগীর (নোবেল)। তারা স্টেশন থেকে মালগাড়ী নিয়ে আসার মূল প্ল্যান করেন, পরে শত শত মানুষ হাত লাগায় ৩ টি রেল ঘুমটিতে বগি স্থাপনে। সংগ্রামী স্যালুট এই বীরদের।

● ষষ্ঠতঃ পশ্চিম পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী যখন সমগ্র দেশে প্রায় একযোগে ২৫শে মার্চ রাতে “অপারেশন সার্চ লাইট” এর মাধ্যমে বিভিন্ন জেলা শহরে তাদের কর্তৃত্ব স্থাপন করতে থাকে, তখন একমাত্র বগুড়াই সেই জেলা, যে জেলা ২৬শে মার্চ মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলেও প্রায় এক মাস পাকিস্তানি কর্তৃত্ব থেকে মুক্ত ছিলো। ১৯৭১ সালের ২২শে এপ্রিল পর্যন্ত পাকিস্তানি সেনাবাহিনী বগুড়া দখল করতে পারেনি।

● সপ্তমতঃ বগুড়ার মুক্তিযুদ্ধকে সারা দেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের মধ্যে করেছে অনন্য, যা বাংলাদেশের আর কোথায় ঘটে নি বলে আমার মনে হয়। তা হলো, মুক্তিযুদ্ধের শুরুর দিকেই ১লা এপ্রিল বগুড়ার মুক্তিযোদ্ধারা কিছু ই.পি.আর সেনা সদস্যসহ বগুড়া থেকে ১০ কিলোমিটার দক্ষিনে আড়িয়া বাজার এলাকায় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ২৩ ব্রিগেডের ৯৬ আই পি পি (অ্যামুনিশন পয়েন্ট) দখল করে। এই অ্যামুনিশন ডিপুটি তখন মেজর নূর মোহাম্মাদ নামে এক পাঞ্জাবীর অধীনে ছিল। ২৩ ফিল্ড রেজিমেন্ট এর কিছু সৈন্য অ্যামুনিশন পয়েন্ট পাহাড়া দিতো। এই ডিপুতে বেশ কিছু পশ্চিমা মিলিটারি ও বাঙ্গালী মিলিটারি যৌথ ভাবে অবস্থান করতো। ক্যাপ্টেন নূর মোহাম্মাদ সহ ৬৮ জন সৈন্য আত্নসমর্পণ করে। এ অ্যামুনিশন ডিপুটি দখল করতে মাসুদ আহমেদ শহীদ হন। আমরা যা জানি, এ জানাই যথেষ্ট নয়, জানতে হবে আরো অনেক কিছু। আরো অনেক গভীরে ঢুকতে হবে। আমি পারলাম না। তবে ভবিষ্যতে কেউ নিশ্চয়ই পারবে।

এই বিভাগের অন্য খবর

Back to top button