টিএমএসএসবগুড়া সদর উপজেলা

উৎপাদনমুখী সমবায় করি উন্নত বাংলাদেশ গড়ি – অধ্যাপিকা ড. হোসনে -আরা বেগম

মানুষের ঐক্য ও যৌথ প্রচেষ্টার সাংগঠনিক ব্যবস্থার নাম সমবায়। ব্যক্তি ও সমষ্টির স্বার্থে সমন্বয় ঘটিয়ে আর্থ-সামাজিক অবস্থার কাঙ্খিত পরিবর্তন সাধনে মানবিক প্রযুক্তি হিসেবে সমবায়ের উপযোগিতা অনস্বীকার্য। সমবায় পদ্ধতি উন্নয়নের অন্যতম কার্যকর পন্থা। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের জীবন দর্শনে অন্যতম উপাদান ছিল সমবায়। তাঁর গভীর মানবিক জীবন দর্শণের লক্ষ্যই ছিল ক্ষুধা ও দারিদ্র্য মুক্ত বাংলাদেশ। তাঁর ভাষায় “এই লক্ষ্যে যদি আমাদের পৌঁছাতে হয় তবে অতীতের সমবায় ব্যবস্থাকে আমূল পরিবর্তন করে একটি সত্যিকারের গণমুখী আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে”। ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে সমবায়ী চেতনাকে সর্বগ্রহণযোগ্য করার ব্যবস্থা আছে, সেজন্য জামাতে নামাজ পড়ার মর্তবা অনেক বেশী। প্রতিবেশী ও সমাজের প্রতি দায়িত্বও বেশী।

বাংলাদেশের সমবায় আন্দোলনের একটি সমৃদ্ধ এবং দীর্ঘ ঐতিহাসিক পথ পরিক্রমা রয়েছে। প্রায় ১০০ বছরেরও বেশী সময় ধরে নানা চড়াই-উৎরাই এর মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের সমবায় আন্দোলনকে অগ্রসর হতে হয়েছে। সমবায় শুধু মাত্র একটি উন্নয়ন দর্শনই নয়, এটি আর্থ সামাজিক আন্দোলনও বটে। বিশ্বের প্রায় প্রতিটি দেশে এ আন্দোলন চলমান রয়েছে। মানুষের অংশগ্রহণের মাধ্যমে সমবেত উদ্যোগের এ আন্দোলনকে যথাযথ সমন্বয়ের দায়িত্ব পালন করছে আন্তর্জাতিক সমবায় মৈত্রী সংস্থা ( International Cooperative Alliance- ICA ) । বিশ্বের সকল দেশেই যে সমবায় আন্দোলন অত্যন্ত সফলভাবে বাস্তবায়িত হচ্ছে তা নয়। ICA এর তথ্য অনুযায়ী বিশ্বের সফল ৩০০টি সমবায়ের মধ্যে স্বল্পোন্নত কিংবা পিছিয়ে পড়া অর্থনীতির দেশ সমূহের সমবায় প্রতিষ্ঠান খুব একটা জায়গা করে নিতে পারেনি। এর মানে এই নয় এ দেশগুলোতে সমবায় আন্দোলন ব্যর্থ হয়েছে। প্রতিটি দেশের আর্থ- সামাজিক বাস্তবতা, নীতি-কাঠামো, প্রচলিত সমবায় আইন, নেতৃত্ব, গনমানুষের মানসিকতা ইত্যাদির মধ্যে যথেষ্ট পার্থক্য রয়েছে। তাই সমবায় আন্দোলনের সাফল্য-ব্যর্থতার মধ্যেও দৃশ্যমান পার্থক্য লক্ষ্য করা যায়। বাংলাদেশের সমবায়ের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস পর্যালোচনা করলে যা দেখা যায়ঃ

১৯০৪- কো-অপারেটিভ ক্রেডিট সোসাইটিজ এ্যাক্ট প্রনীত হয়।

১৮৭৫ সালে দক্ষিণ ভারতের বিভিন্ন জায়গায় কৃষক বিদ্রোহ সংগঠিত হয়। এই বিদ্রোহের মূলে ছিল কৃষি ঋণের অভাব, মহাজনী ঋণের চক্রবৃদ্ধিজনিত উচ্চ সুদের হার, কৃষকদের ক্রমবর্ধমান দারিদ্র্য। এ প্রেক্ষিত ১৯০১ সালে ইন্ডিয়ান ফেমিন কমিশনের সুপারিশ মতে এবং তৎকালীন ভাইসরয় লর্ড কার্জন কর্তৃক গঠিত তিন সদস্য বিশিষ্ঠ (লর্ড এডওয়ার্ড ‘ল’ স্যার নিকলসন ও ডুপার নিক্স) কমিটির সুপারিশ অনুসারে ১৯০৪ সালে কো-অপারেটিভ ক্রেডিট সোসাইটিজ এ্যাক্ট প্রনীত হয়।

১৯১২- কো-অপারেটিভ ক্রেডিট সোসাইটিজ এ্যাক্ট প্রনীত হয়।

১৯০৪ সালে প্রনীত কো-অপারেটিভ ক্রেডিট সোসাইটিজ এ্যাক্ট এর আওতায় কেন্দ্রীয় এবং জাতীয় পর্যায়ে সমবায় সমিতি গঠনের সুযোগ না থাকায় দ্বি-স্তর বিশিষ্ট সমবায় সমিতি গঠনের লক্ষ্যে কো-অপারেটিভ ক্রেডিট সোসাইটিজ এ্যাক্ট এর পরিবর্তে কো-অপারেটিভ সোসাইটিজ এ্যাক্ট জারী করা হয়।

১৯১৪- ম্যাকলেগান কমিটি গঠন।

ভারতবর্ষের কো-অপারেটিভগুলোর সমস্যা চিহ্নিত করে সমাধানের উপায় উদ্ভাবনের জন্য ১৯১৪ সালে স্যার এডওয়ার্ড ম্যাকলেগানকে প্রধান করে “ইমপেরিয়াল কমিটি অন কো-অপারেটিভ ইন ইন্ডিয়া” গঠিত হয়। ১৯১৫ সালে ম্যাকলেগান কমিটি সুপারিশ দাখিল করে। এই কমিটির প্রতিবেদনকে ভারতের জন্য সমবায়ের বাইবেল হিসেবে আখ্যা দেয়া হয়।

১৯১৯- সমবায়কে ভরতবর্ষে প্রাদেশিক বিষয় হিসেবে রূপান্তর করা হয়। প্রাদেশিক বিষয় হিসেবে রূপান্তরের ফলে বিকেন্দ্রীকরণের আওতায় বিভিন্ন প্রাদেশিক সরকার তাদের প্রদেশের জনগণের চাহিদা অনুযায়ী সমবায় আইন ও নিয়মাবলী প্রণয়ণ করে।

১৯৪০- বেঙ্গল কো-অপারেটিভ সোসাইটিজ এ্যাক্ট প্রণয়ণ।

সমবায়কে প্রাদেশিক বিষয় হিসেবে ঘোষনার পর বঙ্গদেশে বেঙ্গল কো-অপারেটিভ সোসাইটিজ এ্যাক্ট প্রণয়ণ ও কার্যকর করা হয়। এই আইন সমবায় সমিতি গঠন ও পরিচালনার বিষয়ে পরিপূর্ণ আইন হওয়ায় ১৯৮৪ সালের পূর্ব পর্যন্ত উক্ত আইনের মাধ্যমেই বাংলাদেশে সমবায় আন্দোলন অগ্রসর হয়।

১৯৪২- সমবায় নিয়মাবলী জারী।এটিই এই অঞ্চলে প্রনীতি প্রথম সমবায় নিয়মাবলী। মূলত বেঙ্গল কো- অপারেটিভ সোসাইটিজ এ্যাক্ট ১৯৪০ এর সমর্থনে ১৯৪২ সালে সমবায় নিয়মাবলী জারী করা হয়।

১৯৫৬- কুমিল্লার কোটবাড়ীতে পল্লী উন্নয়ন একাডেমী স্থাপিত হয়। মরহুম সর্ব শ্রদ্ধেয় ডঃ আখতার হামিদ খান সমবায় সংক্রান্ত প্রায়োগিক গবেষনা প্রতিষ্ঠান হিসেবে পল্লী উন্নয়ন একাডেমী প্রতিষ্ঠা করেন। এটি বর্তমানে বাংলাদেশ একাডেমী ফর রুরাল ডেভেলপমেন্ট (BARD) হিসেবে পরিচিত।

১৯৫৮- পাকিস্তান স্টেট ব্যাংক এ অঞ্চলের সমবায়গুলোকে কৃষি ঋণ দেয়া শুরু করে।

১৯৫৯- ডঃ আখতার হামিদ খান উদ্ভাবিত দ্বি-স্তর ভিত্তিক সমবায় কাঠামো ‘‘কুমিল্লা পদ্ধতি” এর পরীক্ষামূলক যাত্রা শুরু।

১৯৬০- সমবায় অধিদপ্তর হতে মাসিক সমবায় এবং ইংরেজী সান্মসিক কো অপারেশন পত্রিকাদ্বয়ের প্রকাশনা শুরু হয়। ১৯৬০ সালে ঢাকার গ্রীন রোড বাংলাদেশ সমবায় কলেজ স্থাপিত হয়।

১৯৬১- বাংলাদেশ জাতীয় সমবায় ইউনিয়ন (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান সমবায় ইউনিয়ন) আন্তর্জাতিক সমবায় মৈত্রী সংস্থার (ICA) সদস্য ভূক্ত হয়।

১৯৬২- প্রথমবারের মত জাতীয় সমবায় নীতিমালা গৃহীত ও প্রচারিত হয়। ১৯৬২ সালে বাংলাদেশ সমবায় কলেজ গ্রীন রোড হতে কুমিল্লার কোটবাড়ীতে স্থানান্তরিত হয়।

১৯৭২- গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের ১৩(খ) অনুচ্ছেদে সমবায় কে সম্পদের মালিকানার ভিত্তিতে একটি পৃথক (২য়) খাত হিসেবে অন্তর্ভূক্ত করা হয়।

১৯৭২-৭৩ উক্ত অর্থ বছরে কুমিল্লা দ্বি-স্তর সমবায় পদ্ধতির সম্প্রসারন কল্পে সমন্বিত পল্লী উন্নয়ন কর্মসূচী (IRDP) দেশের বিভিন্ন থানায় বাস্তবায়ন শুরু করা হয়।

১৯৭৩- বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দেশের দুগ্ধ চাহিদা পূরণের জন্য সমবায়ের ভিত্তিতে দুগ্ধ উৎপাদন প্রক্রিয়াজাতকরণ ও বিপননের লক্ষ্যে মিল্কভিটা প্রতিষ্ঠা করেন।
১৯৮২- সমন্বিত পল্লী উন্নয়ন কর্মসূচীকে বাংলাদেশ পল্লী উন্নয়ন বোর্ড (BRDB) নামে রূপান্তর করা হয়।

১৯৮৪- বাংলাদেশে ১ম বারের মত সমবায় অধ্যাদেশ জারী করা হয়। ১৯৪০ সালের সমবায় আইনকে যুগোপযোগী করে তৎকালীণ সরকার কর্তৃক সমবায় অধ্যাদেশ জারী করা হয়।

১৯৮৭- সমবায় অধ্যাদেশ ১৯৮৪ এর সমর্থনে সমবায় নিয়মাবলী প্রবর্তন করা হয়।

১৯৮৯- স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথমবারের মত সমবায় নীতিমালা প্রবর্তন করা হয়।

২০০১- প্রথমবারের মত বাংলায় সমবায় আইন জারী করা হয়।

২০০২- সমবায় আইন ২০০১ এর কতিপয় ধারা সংশোধন করে সমবায় সমিতি (সংশোধিত) আইন ২০০২ জারী করা হয়।

২০০৪- সমবায় আইন ২০০১ এবং সংশোধিত আইন ২০০২ এর সমর্থনে ২০০৪ সালে সমবায় সমিতি বিধিমালা ২০০৪ জারী করা হয়।

২০১২- দারিদ্র্যমুক্ত আত্ম-নির্ভরশীল বাংলাদেশ গড়ায় সমবায়ী উদ্যোগকে উৎসাহ প্রদান এবং গণমূখী সমবায় আন্দোলনের দিকনির্দেশনার প্রয়োজনে ১৯৮৯ সালে প্রণীত সমবায়নীতিকে যুগোপযোগী করে জাতীয় সমবায় নীতি ২০১২ প্রণয়ন করা হয়।

২০১৩- সমবায় আইন ২০০১ কে অধিকতর সংশোধন করে সংশোধিত সমবায় আইন ২০১৩ জারী করা হয়।ধারাবাহিক ইতিহাস পর্যালোচনায় দেখা যায় সমবায় আন্দোলনকে সাফল্যের লক্ষ্যে পৌছানোর বিষয়টি কিছুটা উপেক্ষিত থাকলেও সমবায়কে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সমবায় বিধানে অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে মালিকানার ২য় খাত হিসেবে স্থান দেয়া হয়েছে। কিন্তু সে অনুযায়ী দেশের বিভিন্ন সেক্টরাল নীতিমালায় (যেমন শিল্পনীতি, কৃষিনীতি, শ্রমনীতি ইত্যাদি) সমবায়কে অধিকতর গুরুত্ব দিয়ে অর্ন্তভূক্ত করার বিষয়টি গুরুত্ব ও দৃশ্যমান হয়নি।

আমাদের সমবায় আন্দোলন হবে সাধারণ মানুষের যৌথ আন্দোলন, কৃষক, শ্রমিক, মেহনতি জনতার নিজস্ব প্রতিষ্ঠান। তাই, আসুন সমবায়ের যাদু স্পর্শে সুপ্ত গ্রাম বাংলাকে জাগিয়ে তুলি। আমাদের সঙ্গবদ্ধ জনশক্তির সমবেত প্রচেষ্টায় গড়ে তুলতে হবে ‘সোনার বাংলা’। রাজনৈতিক স্বাধীনতা তার সত্যিকারের অর্থ খুঁজে পাবে অর্থনৈতিক মুক্তির স্বাদে, আপামর জনসাধারণের ভাগ্যেন্নয়নে। তবেই গণতান্ত্রিক পদ্ধতির মাধ্যমে রূপায়িত হবে সমাজতান্ত্রিক নীতির এবং সেই অভীষ্ট লক্ষ্যে আমরা পৌঁছাবো সমবায়ের মাধ্যমে। এই লক্ষ্যে সমবায়ের চেতনায় জন্ম হয়েছে টিএমএসএস এমপ্লয়িজ কো-অপারেটিভ সোসাইটি লিঃ এর। ভাগ্য উন্নয়নে সমবায় অগ্রনী ভূমিকা রাখছে। যার সাথে জড়িত আছে বেকার ও কর্মমূখী জনগোষ্ঠী।

সমবায় এখন অনেক নতুন নতুন চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন। অন্যদিকে দারিদ্রমুক্ত বাংলাদেশ গড়তে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যকে (Sustainable Development Goal) সামনে নিয়ে সদাশয় সরকার যে কাজ করছে, তা অর্জনের জন্য প্রয়োজন গণমূখী সমবায় আন্দোলন। তাই আসুন উৎপাদনমুখী সমবায় করি উন্নত বাংলাদেশ গড়ি।

অধ্যাপিকা ড. হোসনে -আরা বেগমঅশোকা ফেলো এন্ড পিএইচএফনির্বাহী পরিচালক, টিএমএসএস

এই বিভাগের অন্য খবর

Back to top button