তারুণ্যের কন্ঠস্বর

আত্মহত্যায়_ফেসবুক

বর্তমান যুগে ফেসবুকের ব্যবহার সম্পর্কে আমরা সবাই খুব ভালোভাবেই জানি । কিন্তু এটার বিস্তৃতি কতখানি? এটি কি শুধু মোবাইল ফোনেই সীমাবদ্ধ?

আমার মনে হয় ‘না’ । ফেসবুক শুধু ফোনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়; বরং আমাদের পুরো জীবনযাত্রা অর্থ্যাৎ বাস্তবিক জীবনেও প্রভাব রেখেই যাচ্ছে । কেমনে তা সম্ভব তা অন্যদিন লিখতে চাই । তবে আজ বলতে চাই বর্তমান সমাজের একটি ব্যাধি, ভার্চুয়্যাল জগতের ভাষায় ট্রেন্ড হলো ‘ আত্মহত্যা’।

তবে আত্মহত্যা যে শুধু বর্তমান সময়ে সৃষ্টি তা নয়, অনেক পূর্ব হতেই মানুষ নিজের অসুস্থ মানসিকতার সিদ্ধান্তে উপনীত হয়ে আত্মহত্যা সংঘটিত করেছে। কিন্তু বর্তমান সময়ের কিশোর-তরুণ প্রজন্মে এটার পরিধি অনেকটা বেশি।

আত্মহত্যা সম্পর্কিত দেশ বিদেশের নানান তথ্য উপাত্ত আমাদের সকলেরই জানা, এখন একটু অন্যদিক থেকে চিন্তা করে দেখবো ।

আজ থেকে দশ বছর পূর্বে কিংবা তারও অনেক আগের সময়ের বিবেচনায় যদি আসি তাহলে কি তখন আত্মহত্যা প্রবণতা এত বেশি ছিলো? কিংবা পত্রিকার ফ্রন্ট পেইজের বড় হেডলাইনে কেউ এই শব্দটি প্রায়ই দেখেছে? একদমই দেখেনি এমন কিন্তু এখন প্রতিদিন ফেসবুকের নিউজফিড স্ক্রল করলেই চোখে পড়বে আত্মহত্যা সম্পর্কিত নানান রকমের পোস্ট, নিউজ পোর্টালের লেখা সহ আরো নানান গল্প । আসল তথ্য নিশ্চিত করার উপায় নেই, যেকোনো দূর্ঘটনার আসল কারন জানা নেই কিন্তু ঘুরে ফিরেই আত্মহত্যা কথাটি ভার্চুয়্যাল জগতে ঘুরতে ঘুরতে মাথার মধ্যে যায় গেঁথে ।

এখন আত্মহত্যার মূল কারন হিসেবে সার্বজনীন দিক থেকে ধরে নিতে পারি “হতাশা” কে। এছাড়াও হতাশার সাথে যুক্ত হয়ে আরো ছোট বড় কারন মিলিয়ে সংঘটিত হয় আত্নহত্যা।

 যেমন – নানানভাবে অপমানিত হওয়া, নিজের শখগুলো পূরন করতে না পারা, পরিবার এবং সমাজের কাছে সফল ব্যক্তিত্ব হতে না পারা, প্রেম ভালোবাসায় ব্যার্থতা । মোট কথা বাস্তবিক জীবনের সকল সমস্যার সহজ সমাধান হিসেবে ধারনা করা হয় আত্মহত্যাকে বেছে নেয়া হয় ।

তাহলে আমি মনে করতে পারি আমরা বর্তমান সময়ে মানসিকভাবে দূর্বল, অসুস্থ কিংবা হতে পারে আমাদের মানসিকতা ও চিন্তাভাবনা কন্ট্রোল হচ্ছে অন্য একক কোনো ব্যবস্থা দ্বারা । আর কি সেই ব্যবস্থা সেটা খুঁজতে গেলে ফেসবুক একটি অন্যতম মাধ্যম হিসেবে পাওয়া যায় । কারন হিসেবে বলা যায় আপনার জীবনযাত্রায় ফেসবুকের প্রভাব, যেমন – কোনো বিশেষ রেস্টুরেন্টে খেতে গেলেন, খাবারের আত্মতৃপ্তি মন থেকে বুঝার চেষ্টা যখন করতে যাবেন তখনি মনে হলো ইশশ ছবি তোলা হয়নি, তারপর ছবি তোলা শুরু হলো খাবার সামনে রেখে.. আর এই ছবি তোলার একটাই উদ্দেশ্য আপনার ফেসবুকের অজস্র জনতাকে দেখানোর জন্য পোস্ট দিতে হবে। ঠিক এভাবে ঘুরতে গেলে, নতুন কিছু দেখতে গেলে, আড্ডা দিতে গেলে এমনকি মনের ভাবটা যার জন্য মনে জমে আছে তাকে না বলে ফেসবুকে বলে ফেলেন । এমনকি এতসব নীতি কথাও আপনাদের আমাদের বুঝাতে গেলেও লিখতে হচ্ছে এই ফেসবুকেই!! তাহলে বুঝেন জীবনের কোন অংশে ফেসবুক কন্ট্রোল করে না!

ঠিক সেইভাবেই আমাদের অসুস্থ মানসিকতা লালিত পালিত হচ্ছে আমাদের মনের মত করে বানানো এই ফেসবুক সিস্টেমে ।

মূলত একটি জাতি কিংবা প্রজন্ম যখন উন্নতির দিকে অগ্রসর হয় তখন নিজের মধ্য যথেষ্ট নৈতিকতা এবং সুস্থ জ্ঞান অর্জন করতে হয় ।

যদি ধরি, আমাদের বাবা-মা, শিক্ষক ও অভিভাবক প্রজন্ম সুস্থ পরিবেশে বড় হয়েছেন এবং নৈতিকতার পরিপূর্ণ জ্ঞান অর্জন করেছেন। সেই সাথে বর্তমান সময়ে আমাদেরকে পারিবারিক এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে তাদের জ্ঞানটুকু দিয়ে আমাদের বড় করে তুলছেন । কিন্তু আমরা তরুন প্রজন্ম যদি একটু বাইরের জগতের আপাতদৃষ্টিতে আর্কষণীয় কিন্তু প্রকৃত অর্থে নেগেটিভ অংশকে প্রাধান্য দিতে থাকি তখন কিন্তু আমাদের এসব পারিবারিক এবং প্রাতিষ্ঠানিক সুস্থ শিক্ষাগুলো বোঝা এবং অনেকাংশে অনর্থক মনে হতে থাকবে । একপর্যায়ে আমাদের সামনে একদিকে নতুন চাকচিক্য ভার্চুয়্যালিটির মোহ আবার অন্যদিকে অভিভাবকদের দেখানো ধার্মিক এবং সামাজিক শিক্ষা দুটার মধ্যে তুলনা চলে এবং উঠতি বয়সের দুরন্তপনার জন্য আমরা ঢুকে পড়ি অসুস্থ ভার্চুয়্যাল জগতে । যে জগতে নিজের কল্পিত যোগ্যতাগুলোকে ফেসবুকে সংযুক্ত সবার সামনে তুলে ধরা হয়, রঙিন অংশকে তুলে ধরা হয় বাস্তবকে দূরে রেখে । ফলে এই বাস্তব জীবন ও ফেসবুকীয় জগতের দূরত্ব বাড়তে থাকে এবং একসময় সেখানে নিজস্ব নিয়ন্ত্রণে থাকে না । তাই জীবনের যেকোনো ব্যার্থতায় নিজস্ব বাস্তব সিদ্ধান্ত মাথা থেকে আসে না । আর এসব ব্যার্থতার অংশগুলোকে ঢেকে ফেলার জন্য অসুস্থ মানসিকতা সমাধান হিসেবে সামনে তুলে ধরে ‘আত্মহত্যা’ কে । আবার এই আত্মহত্যা করার পূর্বেও আমরা সেই ভার্চুয়্যাল জগতেই খুঁজে পাই পরম ভরসার স্থান হিসেবে । কারন প্রায় প্রতিটি আত্মহত্যার পূর্বে ফেসবুকে আবদ্ধ হয় কিছু পোস্ট, সেখানে লেখা থাকে বিদায় এবং আক্ষেপ মূলক নানান কথা । পুরো ফেসবুক জাতি দেখতে পায় আবারো একটি ব্যার্থ আর্তনাদ!

আবেগী হয়ে, সময়ের নেগেটিভ দিকে গা ভাসায়ে, বাস্তব থেকে নিজেকে দূরে রেখে নেট দুনিয়ায় চাকচিক্য খুঁজে বেড়ানো প্রজন্ম না হয়ে যদি বাস্তবতার সাথে জীবন পরিচালনা করতো, বাস্তবতার প্রভাব যদি ব্যক্তিগত জীবনের সকল স্থানে রাখতো এবং ফেসবুকে লম্বা পোস্ট না লিখে যদি পরিবারের সাথে নিজের মনের ভাব প্রকাশ করতো, সময় কাটাতো তাহলে এই হতাশায় ভুগে “আত্মহত্যা” নামক শব্দটিকে এতটা পরিচিত মনে হতো না এই তরুন প্রজন্মের কাছে ।

এই বিভাগের অন্য খবর

Back to top button