ই-কমার্সে নারীরা: যে সব বিষয়ে গুরুত্ব দিতে হবে
গত ২০০ বছরে নারীরা বিজ্ঞান আর প্রযুক্তির বিভিন্ন ক্ষেত্রে অনেক গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে। তবুও তারা তাদের অনেক কাজের স্বীকৃতি পায়নি। সুযোগ সুবিধার দিক দিয়েও নারীরা পিছিয়ে আছে। বিশেষ করে প্রযুক্তিতে।
জাতিসংঘের কনফারেন্স অন ট্রেড অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (UNCTAD) এর অধীনে ‘ই-ট্রেড ফর উইমেন’ নামে একটি প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। এই প্রকল্পের প্রজেক্ট ম্যানেজার ক্যান্ডেস এনকোথ বিসেক। তার মতে, “এই সত্যটা সবাই জানে, প্রযুক্তি খাতে নারীদেরকে যে সেভাবে স্বীকৃতি দেয়া হয় না। আর তাদের পেছনে অর্থায়নের পরিমাণও কম।”
ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে নারী উদ্যোক্তাদের এগিয়ে নিতে সবার মধ্যেই নতুন দৃষ্টিভঙ্গি আনা প্রয়োজন। এতে করে যেমন অর্থায়নের পরিমাণ বাড়বে, একইসাথে নারী উদ্যোক্তারাও অনুপ্রেরণা পাবে।
গত বছরের এপ্রিল মাসে সুইজারল্যান্ডের জেনেভায় জাতিসংঘের ‘কনফারেন্স অন ট্রেড অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট’ (UNCTAD) এর উদ্যোগে ই-কমার্স সপ্তাহ পালন করা হয়। সেখানে ই-কমার্সের সাথে জড়িত শীর্ষ নারীরা অংশগ্রহণ করেন। প্রযুক্তি খাতে নারীদের এগিয়ে নিতে কী কী পরিবর্তন আনা দরকার তা নিয়ে আলোচনা করেন তারা। পরিবর্তনের কারনে নারীদের জন্যে যে নতুন সুযোগ তৈরি হবে, তা নিয়েও আলোচনা হয়।
এই আলোচনায় নারীদের ই-কমার্সে অংশগ্রহণ নিয়ে ৬টি পরামর্শ উঠে আসে। এই পরামর্শগুলি বাস্তবায়িত হলে নারীরা কীভাবে লাভবান হবে, তা নিয়েও আলাপ করেন তারা।
#১. নারীদের সামনে না আনতে পারাটা শুধু নারীদেরই না, বরং সবার সমস্যা
ই-কমার্স খাতে লিঙ্গ বৈষম্য কমানোর প্রথম পদক্ষেপই হতে হবে নারীদের সামনে আনা। এরপরের পদক্ষেপ হবে, যারা ইন্টারনেট কেন্দ্রিক ব্যবসা করছে তাদের পৃষ্ঠপোষকতা করা। একই সাথে যারা নারীদের ব্যাপারে অন্যদের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করার জন্যে কাজ করে যাচ্ছে, তাদেরকে সাহায্য করা।
মূলত অনলাইন কেন্দ্রিক ব্যবসায়ী নারীদের সফলতার জন্যে একযোগে সবাইকে কাজ করতে হবে।
#২. কোনো কিছুর অর্থনৈতিক মূল্য বেড়ে গেলে সেটা পুরুষের নিয়ন্ত্রণে ছেড়ে দেয়া যাবে না
এখনো নারীদের সাফল্যকে সমস্যাজনক দৃষ্টিতে দেখা হয়। সফল হওয়ার পরে তাদের ওপর কর্তৃত্ব নিতে পরিবার বা সমাজ কাউকে না কাউকে নিযুক্ত করে। যেমন, প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা ও বিনিয়োগকারীরা নারীর বদলে পুরুষদের কথাকে বেশি গুরুত্বের সাথে নেন। এক্ষেত্রে ই-কমার্সের সাথে যুক্ত নারীদের প্রতি পরামর্শ হলো, ব্যবসার পরিসর অনেক বড় হয়ে গেলেও নিয়ন্ত্রণ ছেড়ে দেয়া যাবে না। কেউ তাদের প্রতিষ্ঠানে বড় ধরনের বিনিয়োগ করতে চাইলে সরাসরি তার সাথেই আলোচনা করতে হবে।
#৩. ইন্টারনেটে আরো বেশি নারীর উপস্থিতি প্রয়োজন
ইন্টারনেটের মাধ্যমে আগের তুলনায় এখন নারীদের ব্যবসা করার সুযোগ বেড়েছে। ইন্টারনেটে নারী উদ্যোক্তারা এখন আন্তর্জাতিক বাজারেও ব্যবসা করছে। তবে পুরুষদের তুলনায় নারীদের ইন্টারনেট ব্যবহারের হার এখনো অনেক কম। একইসাথে উন্নত আর উন্নয়নশীল দেশগুলিতে এই বৈষম্য চোখে পড়ার মতো। সারাবিশ্বে পুরুষদের তুলনায় ১২% কম নারী ইন্টারনেট ব্যবহার করেন। আফ্রিকার সাহারা-নিম্ন অঞ্চলে এই হার ২৫% আর স্বল্পোন্নত দেশগুলিতে এই হার প্রায় ৩৩%। পর্যাপ্ত সুযোগ পেলে নারী উদ্যোক্তারা প্রযুক্তির মাধ্যমে অনেকটাই এগিয়ে যেতে পারে। তবে অনেক নারীই ইন্টারনেট ব্যবহারের সুবিধা না পাওয়াতে ই-কমার্সে অবদান রাখতে পারছে না। ইন্টারনেট ব্যবহারের ক্ষেত্রে এই বৈষম্য দূর করার জন্যে যথাযথ পদক্ষেপ নেয়া দরকার।
#৪. সমতা আনার জন্যে নারীদের বিনিয়োগ আর ব্যবসার দরকার
অনলাইনে ব্যবসা করা নারী উদ্যোক্তাদের দিকে বেসরকারী বিনিয়োগকারীদের নজর দেয়া প্রয়োজন। কারণ, এছাড়া তাদের ব্যবসার পরিসর বাড়বে না। আলোচনায় ক্যামেরুনিয়ান বংশোদ্ভূত প্রযুক্তি উদ্যোক্তা রেবেকা এননচং বলেন, “(নারী উদ্যোক্তাদের জন্যে) আপনি কী করতে পারেন? উত্তরটা হলো, আমাদের প্রতিষ্ঠানগুলিতে বিনিয়োগ করুন। যেসব বিষয়ে আমরা উদ্যোক্তারা সংগ্রাম করে যাচ্ছি, তার মধ্যে একটা হলো বিনিয়োগের অভাব। নারীরা যাতে বিনিয়োগের অর্থটা পায়, সেজন্যে পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন। অন্য কারো বিনিয়োগ ছাড়াই হয়তো আমরা ব্যবসা চালিয়ে যেতে পারি, তবে সেক্ষেত্রে নারী আর পুরুষের মধ্যে সমতা আসবে না।”
.
#৫. ই-কমার্সে নারীদের আরো বড় ভূমিকা পালন করতে হবে
যেসব নারীরা স্বপ্ন দেখতে পারে আর যাদের নেতৃত্ব দেয়ার ইচ্ছা রয়েছে, ই-কমার্স খাতে তেমন অনেক নারীদের আসা প্রয়োজন। নিনা অ্যাঞ্জেলোভস্কা উত্তর মেসিডোনিয়ার বর্তমান অর্থমন্ত্রী। এর আগে তিনি ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান গ্রুপার (Grouper.mk) এর সিইও হিসেবে কর্মরত ছিলেন। তিনি বলেন, “নারীদেরকে স্বপ্ন দেখার জন্যে অনুপ্রেরণা দেওয়া দরকার। তাদের জন্যে দরকারি সব সরঞ্জাম, দক্ষতা আর নেটওয়ার্কের ব্যবস্থা করতে হবে। তারা যাতে বড় বড় পদের দায়িত্ব নিতে পারে, সেজন্যে তাদেরকে সমর্থন দিয়ে যেতে হবে। নারীদেরকে সুযোগ দেয়া হলেই তারা এগিয়ে যাবে। তখন সহজেই তারা নিজের আর নিজের পরিবারের দায়িত্ব নিতে পারবে।”
.
#৬. প্রযুক্তি খাতে সব দেশের সরকারের কর্মসূচি বাড়াতে হবে
লিঙ্গ বৈষম্য দূর করার পাশাপাশি বিভিন্ন দেশের সরকারের কাছে ডিজিটাল অর্থনীতি গ্রহণযোগ্য করে তুলতে হবে। বিশেষ করে উন্নয়নশীল দেশগুলিতে এর প্রয়োজন অনেক। মরক্কোর আইটি সংস্থা ‘এনহান্সড টেকনোলজিস’ মূলত ই-গভর্নমেন্ট নিয়ে কাজ করছে। এর প্রতিষ্ঠাতা এবং সিইও হুদা শাকিরি একটি উদাহরণ দেন। সরকারের এক কর্মকর্তা তাকে একবার বলেছিল, সরকারের পক্ষ থেকে ডিজিটাল অর্থনীতিতে নারীদের দক্ষতা বাড়ানোর চাইতে রাস্তাঘাট নির্মাণ করাটাকে বেশি অগ্রাধিকার দেয়া হয়। এই ধরনের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করা দরকার। বিভিন্ন আইন প্রণয়নের সময় যদি নারীরা ই-কমার্সের গুরুত্বের ব্যাপারে সরকারকে বোঝাতে পারে, তাহলে পরিবর্তন আনা সম্ভব।
যদি যথাযথ শিক্ষা, পরামর্শ, আদর্শ আর অর্থায়ন সম্ভব হয়, তাহলে নারীরা ই-কমার্সের ক্ষেত্রে অনেক বড় শক্তি হয়ে উঠবে। এনকোথ বিসেক বলেন, “ই-কমার্স খাতে নারীরা সাধারণত একসাথে ৩ ধরনের বাধার সম্মুখীন হন।
– – – – – – – – – – – – – – – – – – – – – – – – –
আপনি কি একজন নারী উদ্যোক্তা? আপনার উদ্যোগ নিয়ে বলুন: The Entrepreneur – উদ্যোক্তা
http://www.facebook.com/TheEntrepreneurBD/
– – – – – – – – – – – – – – – – – – – – – – – – –
প্রথমত, সিদ্ধান্ত গ্রহণের সময় তাদের ব্যাপারে গুরুত্ব দেয়া হয় না। দ্বিতীয়ত, ইন্টারনেট ব্যবহার আর ব্যবসায় বিনিয়োগের ক্ষেত্রে তারা সুযোগ কম পান। তৃতীয়ত, বিভিন্ন অঞ্চলের সামাজিক লিঙ্গ বৈষম্য তাদেরকে দমিয়ে রাখার চেষ্টা করে।”
তিনি বলেন, “প্রযুক্তি নারীদের সামনে নতুন নতুন সুযোগ নিয়ে আসতে পারে। সুযোগ পেলে নারীরা গ্রাহকদের সাথে যোগাযোগ আর ব্যবসার ক্ষেত্রে আরো দক্ষ হয়ে উঠবে। আর বর্তমান সময়ের সফল উদ্যোক্তাদের দিকে তাকিয়েই পরের প্রজন্মের নারী উদ্যোক্তারা অনুপ্রেরণা পাবে। এছাড়াও নারীরা এগিয়ে গেলে সমাজে নারীদের প্রতি বৈষম্য কমবে। একই সাথে অর্থনীতিতে নারীদের অবদান বাড়বে আর সরকারের নীতিনির্ধারণের সময়েও নারীরা নিজেদের কথা বলার সুযোগ পাবে।”